'সুখ কাইড়া নিছে সাবেক চেয়ারম্যানের পুতে'

এই জায়গা নিয়ে বিরোধ। কবরস্থান ভেঙে ভবন নির্মাণের চেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত
এই জায়গা নিয়ে বিরোধ। কবরস্থান ভেঙে ভবন নির্মাণের চেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নিজমাওনা গ্রামের নির্যাতিত নিরীহ পাঁচ পরিবার অবশেষে আদালতে মামলা করেছে। দুই মাস থানায় ঘোরাঘুরি ও ধরনা দিয়ে মামলা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁরা।

পরিবারগুলোর অভিযোগ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জের ধরে পাঁচ পরিবারের নারী-পুরুষদের বিরুদ্ধে মামলা এবং হামলা করে চরম নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটতে হয় কয়েকজন নারী-পুরুষকে । ওই নির্যাতনের বিষয়ে পরিবারগুলো থানায় মামলা দিতে গেলে মামলা নেওয়া হয়নি।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে এলাকার কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে খালেদ মোহাম্মদ ইকবালকে। ইকবাল গাজীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি এবং গাজীপুর বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ইকবালের সহযোগী মো. তাইজউদ্দিন, সাদ্দাম হোসেন, মো. উজ্জ্বল মিয়া ও ফয়েজ উদ্দিন।

পরিবারগুলোর অভিযোগ, নিজমাওনা গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলেরা গাজীপুর মৌজার সিএস এবং এসএ ৮১৫ দাগের ১০৯ শতাংশ জমিটি ৪৬৭০ নম্বর দলিলের মাধ্যমে ২০০৬ সালে স্থানীয় আবদুল মজিদ গংদের কাছ থেকে কেনেন। কিন্তু চেয়ারম্যানর ছেলে খালেদ মোহাম্মদ ইকবাল এসএ ৫৫৫ দাগে ৫৪৪৪ নম্বর দলিলের মাধ্যমে জমি কিনলেও দখল নিতে চান ৮১৫ দাগের জমিটি। সেই জমিটি ২০১১ সালে ইকবাল ও তাঁর তিন বোনের নামে নামজারি করে নেন। বিষয়টি জানতে পেরে এসি ল্যান্ড অফিসে মিস কেস করেন দরিদ্র পরিবারগুলো।

এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইকবাল ও তাঁর লোকজন পরিবারগুলোর ওপর সম্প্রতি হামলা করে এবং পরপর চারটি মামলা করে। আরফান আলীর কলেজপড়ুয়া ছেলে সারোয়ার হোসেনকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয় এবং বাড়ির নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। আহত অবস্থায় শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দেলোয়ার হোসেন নামে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু তা–ই নয়, সাত মাসের শিশুকে মায়ের কোল থেকে রেখে মা আলেয়া বেগমকে গ্রেপ্তার করে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষককেও ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।

জানতে চাইলে খালেদ মাহমুদ ইকবাল নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই সম্পত্তি আমার। তারা আমার কেয়ারটেকারকে হামলা করে আহত করায় আমি মামলা করেছি। তাতে তারা গ্রেপ্তার হয়েছে। কারও ওপর হামলা করে মামলা করিনি আমি।

তবে গাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সত্তরোর্ধ্ব নুরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামের গরিব মানুষের ওপর যেন জুলুম না করে সেটা আমি বারবার বলেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শুনছে না। হের টাকা পয়সা আছে। গায়ের জোর আর ক্ষমতা দিয়ে সবকিছুই করার চেষ্টা করছে। কবরস্থানের ওপর এখন বিল্ডিং বানাইতে বাধা দেওয়ায় মানুষগুলোকে অনেক মারধর করছে। বিষয়টি আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। এর বেশি কিছু তো করার ক্ষমতা নেই আমার।’

মামলার বাদী সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘সারাক্ষণ ভয়ে থাকি, কখন জানি পুলিশ আমারে ধইরা নিয়া যায়। বিএসএস ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। সবার সামনে এলোপাতাড়ি আমারে মারপিট করল ইকবাল ও তার লোকজন। বিচার তো পাইলামই না, উল্টো আরও আমাকে ধইরা নিয়ে জেলে দিল। জেল থেকে আইসা শ্রীপুর থানার বারান্দা দিয়া ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ, পুলিশ মামলা নেয় না। বহু কষ্টে গাজীপুর আদালতে মামলা করছি।’

সারোয়ার হোসেন আরও বলেন, থানায় মামলা দিতে গেলে এসআই আশরাফুল্লাহ মামলা নেননি। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সাংসদ রহমত আলীর কাছে গেলে তিনি ওসির কাছে ফোন করে বিষয়টি দেখার জন্য বলে দেন।

শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল্লাহ বলেন, ‘নিজমাওনা গ্রামের ইকবাল ডাক্তারের দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমি। আমার সঙ্গে সারোয়ারের দেখাই হয়নি।’

এ বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় আমার কাছে মামলা করতে কেউ আসেনি। ভুক্তভোগী এলে বিষয়টি অবশ্যই আমি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতাম। আর সংসদ সদস্য মহোদয়ও আমাকে এ বিষয়ে ফোন দেননি।’

ভুক্তভোগী আসান আলী বলেন, ‘ওরা জমি কিনছে অন্য দাগে, আর দখলে নিতে চায় আমাদের জমি। নামজারি করে নেয় সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে। এখন ইকবাল একের পর এক মামলা দিচ্ছে। কবরস্থান গুঁড়িয়ে সরকারি খাসজমিতে দালান করছে কিন্তু কিছুই বলার নেই।’

সারোয়ার বলেন, ‘আমার দাদি হালিমা বেগম ও জেঠা শাহজাহান মুন্সির কবর গুঁড়িয়ে দিয়ে দালান করছে ইকবাল।’

হামলার শিকার শাহজাহান মুন্সির পুত্রবধূ আকলিমা আক্তার বলেন, ‘মিথ্যা মামলায় জেল খাটলাম, এখন ঘরে ঠিকমতো থাকতে পারি না। বাড়িতে এসে আমাদের হুমকি দেয়, গালাগালি করে। ইকবাল আমাগো সব শান্তি কাইড়া নিয়া গেছে।’
ভুক্তভোগী বাদশা মিয়ার স্ত্রী আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমার সাত মাসের দুধের সন্তান ফালাইয়া ধইরা নিয়া গেছিল পুলিশ। একটার পর একটা মামলা দিতাছে আমগোরে। আমরা কোনো বিচার পাই না।’

শাহজাহান মুন্সির স্ত্রী বৃদ্ধা মানিকজান বেগম বলেন, ‘আমাগো সব সুখ কাইড়া নিছে সাবেক চেয়ারম্যানের পুতে।’

হাসমত আলী ফরাজী প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক মো. মফিজউদ্দিন ফরাজী বলেন, ‘সেই দিন নির্মমভাবে হামলা করেছিল চেয়ারম্যানের ছেলে ইকবাল ও তাঁর লোকজন। রক্তাত্ব অবস্থায় পড়ে থাকায় সারোয়ারকে নিয়ে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাই। আর এ কারণে আমাকেও মামলায় আসামি করে এবং গ্রেপ্তার করিয়ে জেল খাটায়।

এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেহেনা আকতারের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টি তাঁর নজরে আসেনি। কেউ জানায়ওনি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন তিনি।