খুপরি ঘরে মমতাজ উদ্দিনের কাটল ১০ বছর

খুপরি ঘরের সামনে বসে আছেন বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিন। গত ১০ বছর ধরে তিনি স্ত্রীসহ ওই ঘরে থাকেন। রাজাবাড়ি বাজার এলাকা, রাজাবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়ক, শ্রীপুর উপজেলা, গাজীপুর, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
খুপরি ঘরের সামনে বসে আছেন বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিন। গত ১০ বছর ধরে তিনি স্ত্রীসহ ওই ঘরে থাকেন। রাজাবাড়ি বাজার এলাকা, রাজাবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়ক, শ্রীপুর উপজেলা, গাজীপুর, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

আকাশে মেঘ দেখলে পাখির বাসার মতো খড়কুটো দিয়ে তৈরি ঘরে কোনোমতে আশ্রয় নেন মমতাজ উদ্দিন (৭৫)। ঝড় এলে ঘরের ওপর ছাতার মতো দাঁড়িয়ে থাকা জামগাছটাই তাঁর ভরসা। রাস্তার পাশে খালের পাড়ে ওই খুপরি ঘরে তিনি থাকেন ১০ বছর ধরে। বছরে সাত মাস মাছ শিকার, আর বাকি সময় ধারদেনা করে চলে তাঁর জীবন। সহয়-সম্বল বলতে টিনের ছাপড়ার খুপরি ঘরটাই। সেই ঘরে একটাই কক্ষ, একটাই দরজা। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান—সবই ঘরটিকে ছুঁয়ে যায়। শত কষ্টে-দারিদ্র্যে বৃক্ষতলের ঘরটাই তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল। এ যেন তাঁর বৃক্ষতলে দুঃখনিবাস।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি বাজারের উত্তর দিকে রাজাবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়কের এক পাশে বসতি গড়েছেন কুদ্দুস মিয়ার ছেলে মমতাজ উদ্দিন। তাঁর ঘরের আশপাশে অন্তত আধা কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। গতকাল বুধবার নিজের ঘরের সামনে মন খারাপ করে বসেছিলেন বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। লম্বা গড়ন, মুখভর্তি দাড়ি। কঠোর পরিশ্রম ও বয়সের ছাপ পুরো শরীরে। তাঁর ঘরের পাঁচ ফুট পূর্ব দিকেই বয়ে গেছে একটি খাল। এর সঙ্গে জীবিকা আর জীবনকে গেঁথেছেন একসূত্রে। দেশে প্রতিবছর কতই না উৎসব আসে। কিন্তু সেই উৎসবের ছিটেফোঁটাও লাগে না এই খুপরি ঘরে। ঈদ এলে মমতাজ ঘরের সামনে বসে গ্রামভরা মানুষের উচ্ছ্বাস দেখেন। জীবনযুদ্ধে হাঁপিয়ে ওঠা এই বৃদ্ধের এখন দিন কাটে সুনসান নীরবতায়।

মমতাজের ছেলে আক্তার হোসেন (৩৫) ও মেয়ের নাম মার্জিয়া। ছেলে মানুষের বাড়িতে কাজ করেন ও মৌসুমের সময় মাছ শিকার করেন। মার্জিয়াকে পাশের চিনাশুকানিয়া গ্রামে দিয়েছেন বিয়ে। মেয়ের জামাই এসিআই কোম্পানিতে চাকরি করেন। স্ত্রী আয়েশা খাতুন গৃহিণী। খড়কুটোর ঘরে স্বামীর সঙ্গে বসবাস তাঁর। মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘তিনি রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর ওয়ার্ডের মেম্বার হলেন শহিদুল্লাহ। প্রতিবছর যেকোনো নির্বাচন এলে তাঁর কদর বেড়ে যায়। প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি মিলে তাঁর জন্য। কিন্তু কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। কিছুদিন আগে স্থানীয় মেম্বারের কল্যাণে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। এতে এখন তিনি প্রতি মাসে ৫০০ টাকা পান।’

সড়কের পাশে বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিনের খুপরি ঘর। রাজাবাড়ি বাজার এলাকা, রাজাবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়ক, শ্রীপুর উপজেলা, গাজীপুর, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
সড়কের পাশে বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিনের খুপরি ঘর। রাজাবাড়ি বাজার এলাকা, রাজাবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়ক, শ্রীপুর উপজেলা, গাজীপুর, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

এত বয়সে এসে জীবনের ঘানি টানা বিষয়ে মমতাজ উদ্দিন বলেন, বছরে সাত মাস পাশের খালে-বিলে মাছ ধরে তা বিক্রি করেন তিনি। এতে দৈনিক দেড় শ থেকে মাঝেমধ্যে তিন শ টাকাও বিক্রি ওঠে। এই দিয়েই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সংসার। চৈত্র থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত কোনো জায়গায় মাছ মেলে না। সে সময় মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে চলতে হয় তাঁকে।

কুঁড়েঘর বিষয়ে মমতাজ বলেন, ‘যখন আকাশ কালো হয়, তখন খুব ভয়ে থাকি। তবে মনের ভেতর জোর পাই, জামগাছটার দিকে তাকিয়ে। মনে মনে বলি, জামগাছটা থাকলে আমিও থাকব। দীর্ঘদিন ধরে জামগাছটা টিকে আছে, আমিও আছি।’ তিনি বলেন, ‘মিটালু গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি একদিন এমন দুর্দশা দেখে আমাকে ঘর তৈরি করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি আর পরবর্তী সময়ে আসেননি।’ তিনি বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়া চেয়ারম্যান তো চলাচল করে, আমার ঘরটা কি ওনার চোখে পড়ে না? এই যে বান-তুফানে বিবি নিয়া থাকি, কেউ দেখে না।’

মিটালু গ্রামের বাসিন্দা রিপন বলেন, ‘এই বুড়ো মানুষটা দীর্ঘদিন ধরে এখানে তাঁর স্ত্রীসহ বসবাস করছেন। তাঁর নেই কোনো নাগরিক অধিকার। অথচ ভোট দিচ্ছেন, নেতা নির্বাচন করছেন। ঠুনকো ঘর, যেকোনো সময় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে তিনি থাকেন অথচ দায়িত্ববান কেউ কোনো দিন ঘরটা ভালো করে তৈরির উদ্যোগ নিলেন না।’

রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শহিদুল্লাহ সরকার বলেন, ‘আমরা তাঁকে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। বিভিন্ন সময় তাঁকে সহযোগিতাও করা হয়। তাঁর জন্য ঘরের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে চিন্তা করব।’

গাজীপুর সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক শাংকর শরণ সাহা বলেন, ‘এই হতদরিদ্র ব্যক্তির বিষয়ে আমি জেনেছি। বয়স্ক ভাতা তো দেওয়া হয়েছে। ওনার পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের প্রতি আবেদন করলে ওই ব্যক্তির জন্য সহযোগিতা মিলতে পারে।’