হামলার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের দৃষ্টি আকর্ষণ

গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে। এখানে হামলা চালানোর জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিশ্বের বড় বড় জঙ্গি সংগঠনের অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। তাই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে—এমন ধারণা ছিল জঙ্গিদের।

হোলি আর্টিজান মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম আজ সোমবার এ কথা বলেন। সকালে রাজধানীর মিন্টো রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জানান। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ হামলার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।

মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সংখ্যায় বিদেশিকে তারা হত্যা করতে পারবে, ততই দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। এ কারণেই তারা হোলি আর্টিজানকে বেছে নেয়।

হোলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র নিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগপত্র দাখিল করেছি ৮ আসামির বিরুদ্ধে। তদন্তকালে মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা এ ঘটনায় এসেছে। এ ঘটনায় যারা সরাসরি অংশ নিয়েছিল, তারা ঘটনাস্থলেই অভিযানে মারা যায়। এরপর আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানে আটজন নিহত হয়েছে। আর আটজন জীবিত রয়েছে, যাদের মধ্যে ছয়জনকে জীবিত গ্রেপ্তার করেছি৷ আর দুজন আছে, যাদের আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্টের আবেদন আমরা আদালতে পাঠিয়েছি।’

উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা
আজ মনিরুল ইসলাম জানান, হোলি আর্টিজানে নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল রেহান ইমতিয়াজ এবং খায়রুল ইসলাম পায়েল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা। বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো। সরকারকে কোণঠাসা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা। সরকার যাতে চাপে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে চলে যায়।

মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিরা মনে করেছিল, আসল জঙ্গিদের না ধরতে পেরে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন নিপীড়ন করা হবে। এতে মানুষ যাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে সরকারের ওপর। সাধারণ মানুষ যেন সরকারের ওপর বিক্ষোভ করে—জঙ্গিরা একেই কাজে কাজে লাগাতে চেয়েছিল।

মনিরুল ইসলাম বলেন, হোলি আর্টিজানের ঘটনার আগে জঙ্গিরা আরও কয়েকটি স্থানে রেকি করেছিল। কিন্তু তাদের বিচারে বেরিয়ে এসেছে, তারা হোলি আর্টিজানেই চালাবে। প্রথমত, এখানে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা তেমন ছিল না। দ্বিতীয়ত, এ জায়গাটা পালানোর জন্য সুবিধাজনক হবে। পাশাপাশি এ এলাকায় ঘটনা চালালে সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশি একসঙ্গে পাওয়া যাবে। এ কারণেই তারা ঘটনার দু-তিন আগে হোলি আর্টিজানকে টার্গেট করে। এ ছাড়া ২৭ রমজান ছিল এ ঘটনার দিন। তারা মনে করেছে, এ জঘন্য কাজে তারা বেশি সোয়াব পাবে।

মনিরুল ইসলামের ভাষ্য, প্রথমে জঙ্গিরা হোলি আর্টিজান টার্গেট করেনি। তারা টার্গেট করেছিল ঢাকার যেখানে বেশিসংখ্যক বিদেশি পাওয়া যাবে, এমন কোনো জায়গা। সে অনুযায়ী তাদের নেতারা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা টার্গেট করেছিল, শহুরে ব্যাকগ্রাউন্ডের কিছু ছেলে লাগবে, সেই কারণে তারা চারজনকে বাছাই করে। একজনকে শোলাকিয়াতে কাজে লাগায়, বাকি তিনজন রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশ্বির ও নিবরাস ইসলামকে হোলি আর্টিজানে কাজে লাগায়। তাদের যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা কম, তাই গাইবান্ধায় একটি ক্যাম্পে কথিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক অপারেশনে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পাঠায়। পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাকগ্রাউন্ডের যে দুজন রয়েছে—উজ্জ্বল ও পায়েল। তারা অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ। তাদেরকে এই তিনজনের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে।

এ মামলার তদন্ত করতে দুই বছর লাগল কেন? এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, এ ঘটনায় সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। জীবিত কাউকে ধরা যায়নি। ফলে আলামত পরীক্ষা ও প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করতে সময় লেগে যায়। অভিযানকালেও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে, যাদের জীবিত ধরতে পারলে আরও বেশ কিছু তথ্য পেতে পারতাম, আরও দ্রুত তদন্ত শেষ হতো। এ ছাড়া তদন্ত যাতে নির্ভুল হয়, এ কারণে আমাদের কিছু সময় লেগেছে।

মনিরুল বলেন, ‘বিদেশি ১৭ জন, ৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক এবং ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা এ হামলায় নিহত হয়েছেন। তাঁদের আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমরা চেয়েছি নিহত ব্যক্তিদের হত্যাকারী অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে, যাতে তাঁদের স্বজনেরা শান্তি পান।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ঘটনায় ১৭ জন সার্ভাইভার যাঁরা ভেতরে ছিলেন, তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছি, ৭৫টি আলামত বিজ্ঞ আদালতে পাঠিয়েছি। নিহত ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন বিলংইংস (জিনিসপত্র) স্বজনদের কাছে ফেরত দিয়েছি।’

আজকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন মনিরুল ইসলাম।

প্রশ্ন: এজাহারে নাম থাকলেও চার্জশিটে হাসনাত করিম ও শাওনের নাম নেই কেন? কোন গ্রাউন্ডে তাদের বাদ দেওয়া হলো?
উত্তর: মামলার এজাহারের কলামে কোনো আসামির নাম ছিল না। বডিতে নাম ছিল। যাদের জীবিত উদ্ধার করেছি, এমন ১৭ জনের জবানবন্দি আদালতে দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি যে আসামি জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং আলামত যাচাই-বাছাই করে যাদের সম্পৃক্ততার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের নাম চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: হামলার নিয়ে হাসনাত করিমের ব্যাখ্যা কী?
উত্তর: যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের দেওয়া তথ্যের পাশাপাশি আমরা আরও জানতে পেরেছি, নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে এ হামলা করা হয়েছে। তাদের এই পরিকল্পনার কোথাও আমরা হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাইনি। এ ছাড়া যারা জীবিত গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের কথায়ও হাসনাত করিমের নাম আসেনি। সুতরাং হাসনাত করিমের দেওয়া ব্যাখ্যার চেয়েও অন্য যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তাদের জবানবন্দির ওপর আমরা ডিপেন্ড করেছি এবং চার্জশিটে আদালতকে ব্যাখ্যা করেছি।

প্রশ্ন: তদন্তে সাক্ষী কতজন ছিল?
উত্তর: এ মামলার সব মিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ২১১ জন। এদের মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনা সম্পর্কে জানে কিংবা ঘটনা দেখেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানে। ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।

প্রশ্ন: হামলার পর প্রকাশিত ছবি নিয়ে হাসনাত করিমের ব্যাখ্যা কী?
উত্তর: সেই ছবিগুলো আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সেই বিশ্লেষণের ফলাফল আদালতে ব্যাখ্যা করেছি।

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা পেয়েছেন কিনা?
উত্তর: এ ঘটনায় তামিম, সারওয়ার, মারজানের মতো নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের কাউকেই জীবিত গ্রেপ্তার করতে পারিনি, তারা অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের জীবিত গ্রেপ্তার করতে পারলে নিশ্চিত হতে পারতাম। কিন্তু অন্য যাদের জীবিত গ্রেপ্তার করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমাদের টেকনোলজিক্যাল এভিডেন্সে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাইনি। তবে আমরা মনে করি, তদন্তে আমাদের যে একটা ল্যাকিংস সেটি ছিল, যেসব কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের জীবিত গ্রেপ্তার করতে গেলে আরও তথ্য পেতে পারতাম।

এ ঘটনায় সাইফুল্লা ওযাকির কিংবা বিদেশে অবস্থানরত অন্য কারও নাম কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠনের নাম পাইনি। নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে থাকলেও থাকতে পারত। তবে তামিম যেহেতু নেতা, আন্তর্জাতিক কারও সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারই করার কথা ছিল। এ ছাড়া তার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো অভিযানের আগেই ধ্বংস করে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিদেশি কোনো সংগঠন, আইএস কিংবা আল-কায়েদা, হিযবুত তাহ্‌রীর কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আমরা পাইনি।

আরও পড়ুন...