ঋণ-দেনা, অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে খাবি খাচ্ছে বিমান

বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। মূলধনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ এখন আড়াই গুণের বেশি। নতুন চার উড়োজাহাজ কিনতে নেওয়া ঋণ যুক্ত করলে এটা বেড়ে প্রায় পাঁচ গুণে দাঁড়াবে। অঙ্কের হিসাবে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিমানের দেনা রয়েছে ১ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা।

সরকারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক এই দুরবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে অব্যবস্থাপনা-অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতি। এমনকি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় বিপুল অঙ্কের আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

অথচ বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয়। এর শতভাগ মালিকানা সরকারের হাতেই রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মালিকানা যেহেতু সরকারের, তাই একে রক্ষার দায়ও সরকারের। এমন মনোভাব থেকেই প্রতিষ্ঠানটি নামতে নামতে ঋণযোগ্যতা হারালেও কর্তাব্যক্তিদের কোনো হেলদোল নেই। তাঁদের আশা, সরকার বাড়তি তহবিল দিয়ে এই ‘শ্বেতহস্তী’ টেনে যাবে।

বিমানের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিমান ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন রাষ্ট্রের সার্বভৌম গ্যারান্টির বিনিময়ে বোয়িং কোম্পানি থেকে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ কেনার জন্য বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছে।

বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) মুহাম্মদ এনামুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, এখন সমস্যা তিনটি। এক. উড়োজাহাজ কেনা বাবদ যে ঋণ নেওয়া হয়, তা পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১২ বছর। এটা যদি ২০ বছর করা যেত, তাহলে কিস্তির পরিমাণ কমত। দুই. বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেশি। এ কারণে বিমানের পরিচালন খরচ বেশি হয়। খরচের ৫০ শতাংশ যায় তেল কেনায়। গত এক বছরে ছয় দফা তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এ দেশে। তিন. টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে গেছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এখন সরকারের কাছে নগদ তহবিল চায় বিমান কর্তৃপক্ষ। চেয়ারম্যান এনামুল বারী বলেন, বিমান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে বিশ্বের ১৫টি শহরে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজির সংকটে পড়েছে। এর যাঁরা মালিক, তাঁদের উচিত এই সংকট উত্তরণে বিনিয়োগ করা।

কার্গো শাখায় লুটপাট
প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকটের এই চিত্র বিমানের উচ্চপর্যায়ের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু কেউ গা করছে না। অনিয়ম-দুর্নীতি-অপচয় বন্ধেও কোনো উদ্যোগ নেই। যেমন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো শাখায় বিপুল অঙ্কের দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হয়েছে বিমানের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায়। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অনির্ধারিত মালবাহী ফ্লাইটে (নন-শিডিউল ফ্রেইটার) আসা এবং বিদেশে যাওয়া মালামাল থেকে আদায়যোগ্য মাশুল ৯০ লাখ ২৬ হাজার মার্কিন ডলার (৭২ কোটি টাকার বেশি) বিমানের কোষাগারে জমা পড়েনি।

নিরীক্ষা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এই টাকা মূলত কয়েকজন মিলে লোপাট করেছে। ২০০৮ সাল থেকে এটা চলছে। নিরীক্ষা অনুযায়ী, দুই বছরে ৭২ কোটি টাকা করে ধরলে ১০ বছরে এই খাত থেকে অন্তত ৩৬০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে এই এক খাত থেকেই।

বিমানের সব শাখায় মাশুল বা রাজস্ব আদায় করে হিসাব বা রাজস্ব শাখা। কিন্তু কার্গো হ্যান্ডলিং শাখার মাশুল আদায় করে বিপণন ও বিক্রয় শাখা। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বিপণন ও বিক্রয় শাখার পরিচালক মো. আলী আহসানকে সম্প্রতি যাত্রীসেবা শাখায় বদলি করা হয়। তিনি ২০১২ থেকে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মহাব্যবস্থাপক (কার্গো) ছিলেন। তারপর হন বিপণন শাখার পরিচালক।

কার্গো শাখার এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে মো. আলী আহসান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিষয়টি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কী হারে মাশুল আদায় করা হবে, তার একটা দর থাকতে হয়। কিন্তু মাশুল আদায়ের জন্য কোনো সার্কুলার ছিল না।

তবে তাঁর এই তথ্য ঠিক নয়। সার্কুলার ছিল, যার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে মাশুল আদায় হয়েছে এবং তা কোষাগারে জমা পড়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনেই বলা আছে। এ তথ্য জানালে আলী আহসান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে অ্যাডহক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একেক দরে তাঁরা মাশুল আদায় করে থাকেন। চট্টগ্রামে হয়তো সেভাবে আদায় হয়েছে। এখন ঢাকায়ও আদায় করা হচ্ছে।

তবে এ যুক্তি নাকচ করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের নিরীক্ষায় এবং গত বছর মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে কার্গোতে আর্থিক নানা অনিয়মের বিষয়টি এসেছিল। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়নি। বিমানের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, এটা কারও ব্যক্তিগত ব্যত্যয়ও হতে পারে, আবার সমষ্টিগতও হতে পারে। তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।

জিডিএসে বছরে শতকোটি টাকার অনিয়ম
বিমানের টিকিট বুকিং দেওয়ার জন্য গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা-ও বিমানের স্বার্থবিরোধী।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ৩০০ আসনের একটি ফ্লাইটে ২ থেকে ৩ হাজার বুকিংও হয় অনেক সময়। যার অধিকাংশ বুকিং বাতিল হয় বা যাত্রী যাত্রার তারিখ বদল করেন। প্রতিটি বুকিং ও বাতিলের জন্য জিডিএস কোম্পানিকে একটা মাশুল দিতে হয় বিমানকে। গত মাসে জিডিএস কোম্পানির বিল ছিল ১৪ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা)। এই বিল ২২ লাখ ডলারও হয়েছে কোনো কোনো মাসে।

অভিযোগ আছে, শুধু জিডিএসের বিল বাড়াতে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি প্রচুর টিকিট বুকিং দেয় আবার বাতিলও করে দেয়। যার বিনিময়ে ওই সব এজেন্সি জিডিএস কোম্পানি থেকে কমিশন পায়।

মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এসেছে, জিডিএস কোম্পানিকে যাচাই ও প্রত্যয়ন ছাড়াই টিকিট বিক্রি, বুকিং ও বাতিল ফি দেওয়ায় বছরে প্রায় শতকোটি টাকার অনিয়ম হচ্ছে বিমানে।

বিমানেরই একটা সূত্র বলছে, এমিরেটসের মতো বিমান সংস্থা সাশ্রয়ের জন্য এখন আর জিডিএস ব্যবহার না করে ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন ব্যবহার করছে। বিমানেরও ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন আছে; যা ব্যবহার করলে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সাশ্রয় হবে। কিন্তু এ নিয়ে বিমানের কোনো চিন্তা, উদ্যোগ নেই। আবার কেবল যে টিকিট বিক্রি হয়েছে (ফ্লোন প্যাসেঞ্জারের), শুধু তার ওপর মাশুল নির্ধারণ করে চুক্তি করলেও বিমান লাভবান হবে।

এ বিষয়ে বিমানের চেয়ারম্যান এনামুল বারী বলেন, ‘চেষ্টা করছি, প্রতিটি শাখা যতটা সম্ভব ঠিক করা। কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।’