হামলা-মামলা আর হয়রানির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ প্রার্থীদের

সিলেট নগর পুলিশের উপকমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ের সামনে ২১ জুলাই নিজের কর্মীদের ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন বিএনপি-মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট
সিলেট নগর পুলিশের উপকমিশনারের (দক্ষিণ) কার্যালয়ের সামনে ২১ জুলাই নিজের কর্মীদের ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন বিএনপি-মনোনীত প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নগরী। নির্বাচনী প্রচারের উত্তাপের পাশাপাশি হামলা-মামলা আর হয়রানির পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছেন প্রার্থীরা। নাগরিক সমাজ আর রাজনৈতিক মহলের আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সিলেটের রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশ সব সময়ই ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। এবারের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যেও তেমন কোনো উত্তেজনাও ছিল না। গত এক সপ্তাহে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী একসঙ্গে চারটি গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি বসে বক্তব্য দিয়েছেন। সিলেটের উন্নয়নে নিজেদের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ দেখিয়েছেন। তারপরও নির্বাচন ধীরে ধীরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষ থেকে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি হয়রানির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। তাঁর দলের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা নেতা-কর্মী এবং ঘনিষ্ঠদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ করছেন তিনি। অন্যদিকে, খোদ সরকারি দলের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি হামলা-মামলা নিয়ে নানা অপপ্রচারের তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের গণ্ডি পেরিয়ে ছোটখাটো সংঘাতও দেখা যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বদরউদ্দিন আহম্মদ কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আসাদ উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনিও বিষয়টি লক্ষ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘সিলেটের মানুষ সম্প্রীতি চায়। আমাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়া এবং নেতার ওপর হামলা সত্ত্বেও আমরা পাল্টা কোনো কিছু করিনি। দায়িত্বশীল থাকছি। এখানকার সম্প্রীতি অটুট থাকুক, সেটা আমরা চাই। অহেতুক অভিযোগ দিয়ে কেউ কেউ উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তাদের উচিত সিলেটের মানুষের আবেগের দিকটা মাথায় রাখা।’

২২ জুলাই সিলেট নগরের বোরহানাবাদ এলাকায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো
২২ জুলাই সিলেট নগরের বোরহানাবাদ এলাকায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নির্বাচনী কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, ভোটের সময় নেতা-কর্মীদের মাঠছাড়া করতে উত্তেজনা তৈরি করা হচ্ছে। সিলেটের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির যে অনুভূতি রয়েছে, তাতে আঘাত করা হচ্ছে। উত্তেজনার পরিমাণ সামনের দিনগুলোয় বাড়লে সাধারণ ভোটাররা ভোটের দিন ভোট দিতে আসার বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি। তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ এ নেতা বললেন, সিলেটে খুলনা বা গাজীপুরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়া হবে না। জনগণকে নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে।

নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছিলেন, পরোয়ানা বা মামলা ছাড়া কোনো নেতা-কর্মীকে পুলিশ আটক করলে ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক অবস্থান নেওয়া হবে। সে অনুসারে তিনি ভূমিকা নেন। ১১ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা শ্রমিক দলের এক কর্মীকে আটক করেন। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক টানা ৪০ মিনিট ঘটনাস্থলে অবস্থান করে ওই কর্মীকে ছাড়িয়ে নেন তিনি।

ওই দিন রাত প্রায় ১২টার দিকে ওই এলাকায় দুজন কর্মী ধানের শীষের পোস্টার সাঁটাচ্ছিলেন। এ সময় কয়েকজন যুবক বাধা দেন। কর্মীরা বাধা উপেক্ষা করে পোস্টার লাগানোর চেষ্টা করলে মারধর করে পাশের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে সোপর্দ করা হয়। খবর পেয়ে আরিফুল হক বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে গিয়ে পুলিশের কাছে কর্মী আটকের কারণ জানতে চান। পুলিশ কিছু না বলায় তিনি ফাঁড়ির সামনে একটি চেয়ার নিয়ে বসে পড়েন এবং পরে কর্মীদের ছাড়িয়ে নেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ছাড়া টেলিফোনে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগও করছে দলটি।

গত রোববার আরিফুল হক চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তাঁর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আবদুর রাজ্জাকের বাসায় তল্লাশি করে তাঁকে না পেয়ে ছেলে রুমন রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া বিএনপির নেতা সাইদ আহমদ, এনামুল হক, রাসেল আহমদ ও লিয়াকতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তল্লাশি চালানো হয়েছে নান্টু দাস, সালেহ আহমদ খসরু, কামরুল হাসান শাহীর, হুমায়ন আহমদ, আতাউর রহমান, উজ্জ্বল চন্দ্র, মাহবুবুল হক চৌধুরী, শাকিল মুর্শেদ, এস এম সেফুল ও আবদুস সামাদের বাসায়। এঁরা সবাই বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মী।

জোট-সমর্থিত এই মেয়র প্রার্থী বলেন, নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে, কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তারর বা হয়রানি করা যাবে না। কিন্তু অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তারা এর তোয়াক্কা করছেন না। নেতাদের ফোন করে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, নির্বাচন কমিশন বলছে না, সরকার বলছে না, তাহলে কাকে খুশি করতে পুলিশ কর্মকর্তারা এই ভূমিকা পালন করছেন? এ সময় আরিফুল হক সরাসরি পুলিশের একজন ওসির বিরুদ্ধে সিলেটে সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ আনেন।

এদিকে গতকাল গভীর রাতে আরিফুল হকের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত নেতা জুরেজ আবদুল্লাহ গুলজারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গভীর রাতে তাঁকে নগরীর হাওয়াপাড়া এলাকায় তাঁর নিজের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন জুরেজ। তাঁকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, এর মাধ্যমে বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল বাস্তবায়ন করছে প্রশাসন। এ বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপি। তারা বলছে, নির্বাচন কমিশন এসব বিষয়ে নির্বিকার।

জানতে চাইলে সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থা না নেওয়ার তথ্য সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সরকারি দলের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধেও নোটিশ দেওয়ার তথ্য তুলে ধরেন তিনি। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নির্বাচনী পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন উপহার দেবে।

নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, সবকিছুই এখন নির্বাচন কমিশনের হাতে। তারাই বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাঁর মতে, নির্বাচন কমিশন সত্যিকারের রেফারির ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে। এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে সামনে আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।