জেএমবির তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গি প্রকাশ্যে ছিনতাই

ময়মনসিংহের ত্রিশালে এই প্রিজন ভ্যানটিতে থাকা জেএমবির তিন আসামিকে রোববার সকালে ছিনিয়ে নেয় সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: আলমগীর কবীর, ত্রিশাল।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে এই প্রিজন ভ্যানটিতে থাকা জেএমবির তিন আসামিকে রোববার সকালে ছিনিয়ে নেয় সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি: আলমগীর কবীর, ত্রিশাল।

ময়মনসিংহের ত্রিশালে আজ রোববার সকালে প্রকাশ্যে প্রিজনভ্যানে গুলি চালিয়ে ও বোমা মেরে জঙ্গি মামলার তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ সময় গুলিতে এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। এক উপপরিদর্শকসহ (এসআই) আহত হন প্রিজনভ্যানে থাকা পুলিশের তিনজন সদস্য। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ জানায়, ছিনিয়ে নেওয়া তিন আসামিই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে যুক্ত। জেএমবির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই এই তিন আসামিকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

ফিল্মি কায়দায় আসামি ছিনতাই
গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক আবদুর রাজ্জাকের বরাত দিয়ে আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের হাই সিকিউরিটিতে রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, কারাগারের পার্ট-১-এ সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তৌহিদ ও কারাগারের পার্ট-২-এ মিজান ওরফে বোমা মিজান ওরফে জাহিদুল হাসান সুমনকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় সকাল আটটার দিকে ময়মনসিংহের আদালতে হাজির করার জন্য প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তারা তিনজনই জেএমবির জঙ্গি তত্পরতা মামলায় আসামি। তাদের মধ্যে সালাউদ্দিন ও রাকিব মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও মিজান যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

আমাদের ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি রাকিব, সালাউদ্দিন ও মিজানকে বহনকারী প্রিজনভ্যানটি ময়মনসিংহের দিকে যাচ্ছিল। পথে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রিজনভ্যানটি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে আসামিদের সহযোগীরা। তারা তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেয়। এ সময় এসআই হাবিব, কনস্টেবল আতিক ও সোহেল এবং প্রিজনভ্যানের চালক সবুজ গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে পুলিশ কনস্টেবল আতিক মারা যান। নিহত আতিক (৩৫) গাজীপুর পুলিশ লাইনের কনস্টেবল ছিলেন।

ছিনতাইকারীরা ছিল ২৫-৩০ জন

ময়মনসিংহ মেকিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নিহত পুলিশ সদস্য আতিকের চোখে গুলি লেগেছিল। এ ছাড়া এসআই হাবিবের পেটে ও পুলিশ সদস্য সোহেলের পিঠে গুলি লাগে। চিকিত্সকরা জানান, সোহেলের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত হলেও হাবিবের অবস্থা এখনো বলা যাচ্ছে না।

আমাদের ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আছেন কনস্টেবল সোহেল। তিনি জানালেন, দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় ছিল অন্তত ২৫-৩০ জন। প্রথমে একটি দল গাড়ি থেকে নেমে প্রিজনভ্যানটি লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এ সময় তারা অন্তত পাঁচ থেকে সাতটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটনায়। গুলিতে চালক, তিনি নিজেসহ চারজন আহত হন। এরপর আরেকটি গাড়ি থেকে আরেক দল দুর্বৃত্ত নেমে এসে এসআই হাবিবের কাছে থাকা প্রিজনভ্যানের চাবি ছিনিয়ে নেয়। পরে তারা সেই চাবি দিয়ে প্রিজনভ্যানের তালা খুলে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।

ময়মনসিংহ কতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সারোয়ার জানান, ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মঈনুল হকসহ পুলিশের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

তিন আসামিই দণ্ডপ্রাপ্ত

ছিনিয়ে নেওয়া তিন আসামিই দণ্ডপ্রাপ্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার সূত্র জানায়, সালাউদ্দিনের (৩৮) বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায়। তিনি জেএমবির শুরা সদস্য। তিনি ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সালে তাঁকে জঙ্গি তত্পরতায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয়। ২০১০ সালে তিনি কাশিমপুর কারাগারে যান। তিনি ১৩ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, এর মধ্যে তিনটিতে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা বিচারাধীন আছে।

মিজানের বাড়ি (৩৫) জামালপুর সদরের শেখেরভিটা এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে ২১টি মামলা বিচারাধীন আছে। পাঁচটি মামলায় তিনি সাজা পেয়েছেন, এর মধ্যে একটি মামলায় তাঁর ৩০ বছরের কারাদণ্ড আছে। তিনি ২০১৩ সাল থেকে কাশিমপুর কারাগারে আছেন। জেএমবির প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসির পর সংগঠনটি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মিজান। জেএমবির দুর্ধর্ষ নেতা তিনি। বোমা কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে সংগঠনটিতে রসদ জোগানোর বিষয়ে তিনি ছিলেন তত্পর।

রাকিব হাসানের (৩৫) বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহের বংশীবেল এলাকায়। তিনি জেএমবির শুরা সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে ২৯টি মামলা বিচারাধীন আছে। চারটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে, এর মধ্যে একটিতে তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।

তিনজন আটক

আমাদের সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, ছিনতাইকারীরা ত্রিশাল থেকে টাঙ্গাইলের সখীপুর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে—এমন খবর পেয়ে পুলিশ সখীপুর থানার সামনে গাড়িটিকে আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ছিনতাইকারীরা গাড়ি না থামিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা ঢাকা-সখীপুর সড়কের প্রশিকা কার্যালয়ের পাশে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। পরে ওই এলাকার জামাল নামের এক ব্যক্তি এক ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ওই ছিনতাইকারীর নাম জাকারিয়া (৩০)। তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার জিনারপুর গ্রামে।

সখীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোখলেছুর রহমান জানান, গাড়ি থেকে একটি রিভলবার ও তাজা বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গাজীপুরের সফিপুরের রাসেল (৩৫) ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার রায়হানকে (৩০) আটক করেছে পুলিশ।