কিশোর-কিশোরীদের দিকে নজর বাড়াতে হবে

ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য কুলসুম আক্তার এখন নেত্রীর দায়িত্ব পালন করছে। সে জানাল, তার নিজের যখন মাসিক হয়, তখন সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আর এখন শুধু সে না, কড়াইল বস্তির বেশির ভাগ মেয়ের কাছেই মাসিক কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়—এটি স্বাভাবিক বিষয়। ক্লাবের আরেক সদস্য স্মৃতি আক্তার জানায়, তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ব্র্যাকের কর্মী এবং নিজে সে বিয়ে ঠেকিয়েছে।

আজ রোববার প্রথম আলো আয়োজিত ‘কৈশোরের জয়গান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা জানায়। তারা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যে শক্তি আছে, তাকে ব্যবহার করার আহ্বান জানায়। মেয়েরাও যে পরিবারের হাল ধরতে পারে, সে ধরনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বলেও সে উল্লেখ করে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ এ বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে। কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে প্রথম আলোর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকের আলোচকেরা বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কিশোর-কিশোরী এবং যুব বয়সের জনসংখ্যার আধিক্য থাকবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের উন্নয়ন দ্রুত হবে। আর এই জনগোষ্ঠীর দিকে নজর না দিলে এরাই মাদক, জঙ্গিসহ নানা বিষয়ে জড়িয়ে যাবে, যার প্রভাব হবে খুব ভয়াবহ। তাই এই জনগোষ্ঠীর দিকে পরিবার, কমিউনিটি, রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এই জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

প্রথম আলো আয়োজিত ‘কৈশোরের জয়গান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘কৈশোরের জয়গান’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: প্রথম আলো

বৈঠকের আলোচনায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ বলেন, একক কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কৈশোরের জয়গান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যার যা দায়িত্ব, তা এড়িয়ে না গিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অভিভাবকেরা বলছেন, ছেলেমেয়েরা কথা শোনে না, অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও বলছে, বাবা-মা তাদের দিকে নজর দিচ্ছে না। এই গেমিং বা পিলোপাসিং চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। একই কথা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেলাতেও প্রযোজ্য।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, যৌন হয়রানি, অপুষ্টি, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন বিষয় একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। তাই মাঝখান থেকে একটি সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নিলে সমস্যার সমাধান হবে না। সার্বিক ও সমন্বিতভাবে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা আসকের সংগৃহীত তথ্যের কথা উল্লেখ করে জানান, গত বছর শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটি ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
শীপা হাফিজা বলেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য না জানানো হলে এই কিশোর-কিশোরীরা বিপদে পড়বে। এর প্রভাবে রাষ্ট্র আরও বেশি বিপদে পড়বে। কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেনটেটিভ সীমা সেনগুপ্ত বলেন, কিশোর-কিশোরী বয়সটাই জটিল একটি বয়স। তিনি বাল্যবিবাহের বিষয়টিকে কিশোর-কিশোরীদের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেন, তারা কম বয়সে বিয়ে করবে না—এটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের আছে। সরকারের উপবৃত্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে বেসরকারি ও দাতা সংস্থাকে সমন্বিতভাবে অংশ নিতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গ্রামীণফোন লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন তথ্যপ্রযুক্তি বা আইসিটিকে ‘লার্নিং টুলস’ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কিশোর-কিশোরীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সন্তানকে ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখা সম্ভব না হলেও তারা কোন সাইটে যাচ্ছে, তার নজরদারি করতে হবে অভিভাবককে। বর্তমান যুগের স্মার্ট ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও স্মার্ট প্যারেন্টিং শিখতে হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছেলেমেয়ে ইনস্টাগ্রাম বা অন্য কোনো জায়গায় বিচরণ করলে অভিভাবকদেরও ওই বিষয়গুলোতে জ্ঞান থাকতে হবে। টেকনোলজির সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদেরও এগিয়ে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা বানু বলেন, শিক্ষক, অভিভাবক তাঁদের নিজেদের কৈশোরের নৈতিকতা বা মানদণ্ড অনুযায়ী বর্তমানের কিশোর-কিশোরীদের বিচার করতে চাইলে ভুল করবেন। কেননা কৈশোরের সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আলাদা করে শিশুদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের সুপারিশ করেন এবং কৈশোরের জয়গানের পথে বাল্যবিবাহকে বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করে এ বিষয়টির দিকে নজর বাড়ানোর আহ্বান জানান।
ইউনিসেফের কমিউনিকেশন ফর ডেভেলপমেন্ট, সিফোরডি বিভাগের প্রধান নেহা কপিল শিশু-কিশোরদের জীবনমান উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করতে হলে পরিবারের পাশাপাশি ইমাম, নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ স্থানীয় নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এই প্রতিনিধিরাই পরিবার এবং কমিউনিটিকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করতে পারবেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দীপ্তি রানী সিকদার জানান, মহিলা পরিষদ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি যে একটি অপরাধ, তা বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে পাঠচক্রের আয়োজন করছে যেখানে বয়োসন্ধিকালসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন  যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ। ছবি: আশরাফুল আলম
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ। ছবি: আশরাফুল আলম

ডিনেটের প্রধান নির্বাহী সিরাজুল হোসেন কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে দেশে বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাব রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিষয়টি থেরাপির মধ্যেই আটকে গেছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার অর্পিতা দাস বলেন, পরিবারগুলো কিশোর-কিশোরী বয়সী সন্তানদের জন্য নির্ভরতার কোনো জায়গা তৈরি করতে পারছে না। অভিভাবকেরা সন্তানদের বন্ধু হতে পারছেন না। তিনি জানান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং পরিবারের সদস্যরা দিনে অন্তত এক বেলা হলেও যাতে একসঙ্গে বসে খাবার খান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে।
গোলটেবিল বৈঠকে মোট পাঁচজন কিশোর-কিশোরী বক্তব্য দেয়। স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের সদস্য হৃদিতা হোসেন বলে, ‘আমরা বড়দের কাছ থেকে মনোযোগ চাই। নেতৃত্ব দিতে চাই এবং সিদ্ধান্ত নিতে চাই। অথচ বড়রা তাঁদের সুবিধামতো একবার বলেন, তোমরা এখন অনেক বড়, আবার বলেন, তোমরা কিন্তু খুব বেশি বড় হওনি। ফলে আমরা বিভ্রান্তিতে থাকি।’ কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে কতগুলো সংগঠন নিয়মিত কাজ করছে, তা নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে।
স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের সদস্য আরিফুল ইসলাম বিভিন্ন কুসংস্কারকে কৈশোরের জয়গানের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই সমাজে—এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান জানায়।
ব্র্যাকের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্য মোহাম্মদ হাসান বলে, গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখানো হয়, নায়ক প্রথমে নায়িকাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করছে, এরপর একসময় প্রেম হচ্ছে। এ বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে, কেননা কিশোর-কিশোরী গণমাধ্যমে যা দেখে, তা গ্রহণ করে বেশি।