ভোটের ফলে বিস্মিত-হতাশ জামায়াত

জামায়াতের আমির ও সিলেটে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের
জামায়াতের আমির ও সিলেটে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের

সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের প্রাথমিক ফলে এখানে জামায়াতের পাওয়া ভোট নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। ভোটের আগে জামায়াতের দাবি ছিল, সিলেটে তাদের ভোটের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। কিন্তু ভোটের ফলে তাদের দাবি অনেকটাই শুভংকরের ফাঁকি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে—এমনটাই বলছেন সিলেটের রাজনৈতিক মহল। এত ‘কম’ ভোট পাওয়ায় বিস্মিত ও হতাশ স্থানীয় জামায়াত নেতারা।

ভোটের আগে ২০–দলীয় জোটের কাছে জামায়াত সিলেটে তাদের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার জোরালো দাবি তুলেছিল। জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা জামায়াতকে কয়েক দফা বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। উল্টো জামায়াত বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে তাদের সমর্থনে সরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর মহানগর আমির এহসানুল মাহবুব জুবায়ের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে নির্বাচন করেন।

কিন্তু ভোটের প্রাথমিক ফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে জামানত হারাতে যাচ্ছেন জামায়াতের প্রার্থী। তিনি পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট। এখানকার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৭ জন।

নির্বাচনী আইন অনুযায়ী মোট প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগের কম ভোট পেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। জামানত হলো ভোটে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া অর্থ। জামানত বাতিল হওয়াকে প্রার্থী বা সেই দলের জন্য ‘অমর্যাদাকর’ হিসেবে দেখা হয়।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা-২০১০–এর ৪৪ বিধির ৩ উপবিধি অনুযায়ী ভোট গ্রহণ বা ভোট গণনা শেষ হওয়ার পর যদি দেখা যায় কোনো প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের এক–অষ্টমাংশ অর্থাৎ ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলে তাঁর জামানত সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে।

জামানত রক্ষার জন্য জামায়াতে ইসলামীর ২৪ হাজার ৮৩৩ ভোট পাওয়ার দরকার ছিল।

স্থগিত দুটি কেন্দ্রের মোট ভোট ৪ হাজার ৭৮৭। এ ভোটের পুরোটা পেলেও জামায়াত প্রার্থী জামানত টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।

দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী সিলেটের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা নানাভাবে তাঁদের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় বিএনপি প্রার্থীর নেতা–কর্মীরা নানা হয়রানি, হামলা মামলার শিকার হলেও জামায়াত নির্বিঘ্নে তাদের প্রচার চালাতে পেরেছে। ভোটের দিনও জামায়াতের প্রার্থীকে মাঠে সক্রিয় দেখা গেছে।

ভোটের হিসাব–নিকাশ নিয়ে জামায়াত শুরু থেকেও বেশ উচ্চাভিলাষী তথ্য দিয়েছে সবাইকে। নির্বাচনী প্রচারে তাদের শোডাউনও ছিল দেখার মতো। প্রচুর নেতা–কর্মী ভোটের মাঠে ছিলেন। স্থানীয় রাজনৈতিক মহল বলছে, আশপাশের জেলা ও বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতা-কর্মীদের এনে সিলেটে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে জামায়াত।

ভোটের আগে প্রথম আলোর কাছে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, সিলেটে জামায়াতের রুকন (সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মী ) প্রায় ৬০০ ও সক্রিয় কর্মী ৩ হাজার ৪০০। কর্মী প্রায় ৬ হাজার। তাঁদের পরিবারসহ ভোটার দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার। অন্যদিকে নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জামায়াত তাদের ভোটার ৫০ হাজারের বেশি বলে দাবি করেছে। সেটা স্থানীয় ২০–দলীয় জোট ও কেন্দ্রীয় ২০ দলের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।

তবে এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিল ভিন্ন চিন্তা। তাদের মূল্যায়ন ছিল জামায়াত সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজারের মতো ভোট পেতে পারে। তাই জামায়াতকে সঙ্গে নিতে তাদের একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তাদের মূল্যায়ন ছিল, জামায়াতকে সঙ্গে নিলে সিলেটের বিশাল সংখ্যালঘু ভোট তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

স্থানীয় রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ যা ভাবছে

সিলেটের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজ মনে করছে, জামায়াত তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে সিলেটের ভোটে অংশ নিয়েছে। তাদের মতে, জামায়াত এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। কোণঠাসা কর্মীরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন। কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয়েছেন। তবে ভোটের হিসাবে তাদের অবস্থান শুভংকরের ফাঁকি হিসেবে প্রমাণ হয়ে গেছে। তাদের সাংগঠনিক অবস্থার কথাও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেটা জোটের রাজনীতিতে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাসদের মেয়র প্রার্থী আবু জাফর মনে করেন, বিএনপির ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত আদৌ কোনো ফ্যাক্টর কি না, সেটা বিএনপিকে ভাবতে হবে। সিলেটের ভোটের ফল বিএনপির কাছে প্রমাণ করেছে জামায়াত তাদের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়।

সরকার দলের প্রশ্রয়ে এখানে জামায়াত নির্বাচন করেছে বলে অভিযোগ করেন সিলেটের অন্যতম এ বাম নেতা। তিনি বলেন, অথচ এখানকার তরুণ ও প্রগতিশীল মানুষের চাপে জামায়াত কোণঠাসা ছিল। ভোটের দিন সব দলের এজেন্ট ও কর্মীরা কোণঠাসা থাকলেও জামায়াত ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থান ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ভোটের ফল নিয়ে জামায়াতও হতবাক। মহানগর জামায়াতের আমীর ও সিলেটে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে। এমন ফল আমরা চিন্তাই করতে পারি না।’ নির্বাচনী ফল সম্পর্কে মূল্যায়ন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বসে আগামীকাল নাগাদ সবাইকে জানানো হবে বলে জানালেন এ জামায়াত নেতা।

সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে জামায়াত যে বাড়াবাড়ি করেছে তার ফল পেয়েছে। এবারের ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ হয়ে গেল তারা গুটিকয়েক কর্মীর দল। তিনি আরও বলেন, এখানকার নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে তারা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে ভোটের মাঠে ছিল। আলী আহমেদ বলেন, এ দেশের মানুষ এখনো একাত্তরের কথা ভুলে যায়নি। তাদের অপকর্মের কথা ভুলে যায়নি। তাই মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে সিলেটের মানুষ।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেটের সম্পাদক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফাঁকা বুলি তুলে তারা ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে দর-কষাকষির সুযোগ তৈরির জন্য মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাই শহরের বাইরে থেকে হাজার হাজার মানুষ এনে শোডাউন করেছে, মিছিল করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।

অন্য চার প্রার্থীর জামানতও বাজেয়াপ্ত হচ্ছে

নির্বাচনের ১৩২ কেন্দ্রের প্রাথমিক ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রধান দুই প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট এবং বদর উদ্দীন আহম্মদ কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ৪ হাজার ৬২৬ ভোট। এ দুজন ছাড়া মেয়র পদে অন্য চার প্রার্থী ইসলামী ঐক্যজোটের মোয়াজ্জেম হোসেন, বাসদের আবু জাফর, বিএনপি নেতা ও মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া বদরুজ্জামান সেলিম ও স্বতন্ত্র মো. এহছানুল হক তাহেরের জামানতও বাজেয়াপ্ত হতে যাচ্ছে।

এঁদের মধ্যে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন হাত পাখা প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ১৯৫ ভোট; সিপিবি-বাসদ মনোনীত প্রার্থী আবু জাফর মই প্রতীকে পেয়েছেন ৯০০ ভোট; নাগরিক কমিটির প্রার্থী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বাস প্রতীকে পেয়েছেন ৫৮২ ভোট; এবং সচেতন নাগরিক সমাজের প্রার্থী মো. এহছানুল হক তাহের হরিণ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২৯২ ভোট।