কৌশল ও দক্ষতার কাছেই হারলেন কামরান

আরিফুল হক চৌধুরী ও বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। ফাইল ছবি
আরিফুল হক চৌধুরী ও বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। ফাইল ছবি
>

• বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল এগিয়ে
• আ. লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মূল্যায়নে ঘাটতি
• ভোট সংগ্রহে যুক্ত কর্মীদের দক্ষতায় ঘাটতি ছিল
• আতঙ্ক ছড়ানোর কৌশল হিতে বিপরীত হয়েছে

সরকারি দলের দাপট, অনেক কেন্দ্রে জাল ভোট, পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ—এত কিছুর পরও ভোটের ফল কীভাবে আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে গেল, এটাই এখন সিলেটে আলোচনার মূল বিষয়। আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলছেন, সিলেটে ভোটকেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে স্থানীয় কর্মীদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও কিছু কিছু চেষ্টা হয়েছে, তা না হলে ভোটের ব্যবধান আরও বড় হতো।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, ভোটের সম্ভাব্য চিত্র সম্পর্কে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির মূল্যায়নেও ঘাটতি ছিল। ধারণা করা হয়েছিল, ৪০ হাজার ভোটের ঘাটতি কমাতে পারলে দলের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান জিতবেন। সেভাবে নির্দিষ্টসংখ্যক কেন্দ্রে ভোটের দিনের বাড়তি কৌশল ঠিক করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আনুকূল্য নিয়ে কৌশল প্রয়োগ করা হলেও ভোট সংগ্রহে যুক্ত কর্মীদের দক্ষতায় ঘাটতি ছিল। তাঁরা মেয়রের পাশাপাশি দলের সমর্থক সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর ভোটের জন্যও কাজ করেছেন। তাই নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত ভোট পড়েনি।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, সোমবার ভোটের দিন বেলা পৌনে একটায় আরিফুল মাঠ ছেড়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। তখনই নেতা-কর্মীরা ভাবতে শুরু করেন কামরান জিতে গেছেন। এ অবস্থায় গা ছাড়াভাব চলে আসে নেতা-কর্মীদের। তাই দুপুরের পর ভোটকেন্দ্রের প্রতি সকালের মতো মনোযোগ দেননি নেতা-কর্মীরা।

অবশ্য সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কামরানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব আসাদ উদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সিলেটে প্রচুর উন্নয়ন করেছে। মেয়র থাকায় আরিফুল হক এই উন্নয়নের পুরো কৃতিত্ব নিয়েছেন। ভোটে এর প্রভাব পড়েছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ১০ জন নেতার সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, ভোটের কৌশলেও আরিফুলের সঙ্গে পেরে ওঠেননি কামরান। খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী বা বরিশালের মতো সিলেটেও ভোটের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন মামলা, গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি পুলিশি অভিযান চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর কৌশল হিতে বিপরীত হয়েছে। মানুষের সহানুভূতি গেছে আরিফুলের দিকে। অন্য সিটির মতো সম্ভাব্য এজেন্টদের মামলার আসামি করে চাপে রাখলেও আরিফুল বিকল্প কৌশল অবলম্বন করেন। সেটা হলো, বিভিন্ন দলের কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্টদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন তিনি। ভোটকেন্দ্রে ওই এজেন্টরা আরিফুলের হয়ে কাজ করেন। তাঁর ভোটাররা নৌকা মার্কার স্লিপ নিয়ে ভোট দিতে কেন্দ্রে গেছেন।

সিলেট যেসব কেন্দ্রে জোরজবরদস্তি বা বুথ দখল করে জাল ভোট দেওয়ার বড় অভিযোগ ছিল, তার মধ্যে অন্যতম এমসি কলেজ। ভোটের দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে এই কেন্দ্র সরকারদলীয় কর্মীদের দখলে চলে যায়। এখানে কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেসরকারিভাবে নির্বচিত হওয়ায় কর্মীরা মেয়র প্রার্থী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই কেন্দ্রে ৭৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট পড়ে। কামরান পান ১ হাজার ৩৩৬ ভোট, আরিফুল পান ২৭৮ ভোট। আবার শতাংশ অনুপাতে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে শাহ গাজী সৈয়দ বুরহান উদ্দীন মাদ্রাসা কেন্দ্রে। এখানে ভোট পড়ে ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তাতে কামরান ১ হাজার ৫৭৬ আর আরিফুল ১ হাজার ২৫৭ ভোট পান। এই কেন্দ্রে ভোট নিয়ে বড় কোনো অভিযোগ ছিল না।

ভোটের এই কৌশলের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সিলেট শহরের উন্নয়নে অবদান রাখা এবং ব্যক্তি জনপ্রিয়তাই প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে আরিফুলকে এগিয়ে রেখেছিল। ২০১৩ সালে মেয়র হওয়ার পর কারাগারের ৩০ মাস বাদ দিলে বাকি সময়ে তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সংস্কৃতিকর্মী, নাগরিক সমাজ ও প্রগতিশীল মহলের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। এ ছাড়া গতবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ৩০ মাস কারাগারে থাকায় অনেকের সহানূভুতি পান। যে কারণে দলের একটি অংশ তাঁর পক্ষে সেভাবে না থাকলেও ভোট পেতে সমস্যা হয়নি।

বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পরও ৫৮২ ভোট (বাস প্রতীক) পেয়েছেন। এই ভোট আরিফুল পেলে স্থগিত দুই কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন ছাড়াই তিনি জয়ী হতে পারতেন।

 সিলেটে জামায়াতে ইসলামীর শক্তি নিয়ে যে প্রচার ছিল, সেটাও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দলটির প্রায় ৪০ হাজার ভোট আছে, তাদের বাদ দিয়ে বিএনপি জিততে পারবে না, ভোটের আগে এমন প্রচার ছিল। কিন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করেও দলটির মেয়র প্রার্থী পেয়েছেন ১০ হাজার ৯৫৪ ভোট, যা ২০-দলীয় জোটে জামায়াতের দর-কষাকষির শক্তিকেই খর্ব করেছে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।

জামায়াতের সিলেট মহানগরের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. শাহজাহান আলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘সরকার যেভাবে চেয়েছে সেভাবে ফলাফল হয়েছে।’

অবশ্য প্রচারণার শুরু থেকেই আরিফুল জামায়াতকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, জামায়াত ১০ হাজারের বেশি ভোট পাবে না। এর চেয়ে সিলেট শহরের ভোটের রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের ভোট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১ লাখ ভোটার আছেন। আরিফুল ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। অবশ্য তখন দলীয় প্রতীকে ভোট হয়নি। এবার দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও সংখ্যালঘুদের ভোটের বড় একটা অংশ তিনি পেয়েছেন বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত ১৯টি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৬টি কেন্দ্রে কামরানের চেয়ে আরিফুল বেশি ভোট পেয়েছেন। বাকি ১৩টি কেন্দ্রে কামরান বেশি ভোট পেলেও আরিফুলের ভোট একেবারে কম ছিল না। এই ১৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫টিতে জাল ভোট বা বুথে ঢুকে জোর করে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে।

এই নির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সিলেটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ভাষাসংগ্রামী মো. আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, আরিফুল কিছু কাজ করেছেন, যা দৃশ্যমান ছিল। অন্যদিকে মানুষের সঙ্গে কামরানের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু সুসম্পর্কের চেয়েও দৃশ্যমান কাজটাই মানুষের মনে উঁকি দিয়েছে বেশি। সে কারণে আরিফের পক্ষে অনেকে রায় দিয়েছেন।

বিজয়ীকাউন্সিলর

আ.লীগ সমর্থিত ১৬ জন
বিএনপি সমর্থিত  জন
জামায়াত সমর্থিত  জন
স্বতন্ত্র প্রার্থী  জন
মোট কেন্দ্র ১৩৪টি
গড় ভোট ৬১.৭৪%
৮০ শতাংশের বেশি ভোট ৯টি কেন্দ্রে।
৯০ শতাংশের বেশি ভোট ১টি কেন্দ্রে
৫ ওয়ার্ডের ফল স্থগিত