হারজিতের এত বড় ব্যবধান কেন

২০১৩ সালের নির্বাচনে ৪৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এবার এত বড় ব্যবধানে হারবেন, তা অনেকেরই ধারণায় ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, এই নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে উন্নয়ন। এ ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, ভয় দেখিয়ে কোণঠাসা করে রাখা, ভোটের দিন এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এবং দিনভর ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শক্তি প্রদর্শন ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।

আগের সিটি নির্বাচনে বুলবুল ৪৭ হাজার ৩৩২ ভোটে খায়রুজ্জামান লিটনকে হারিয়েছিলেন। এবার মোসাদ্দেক হোসেন হেরেছেন ৮৭ হাজার ৩৯৬ ভোটের ব্যবধানে। কেন তিনি এত ভোটে হারলেন, তা নিয়ে শহরে চলছে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।

নবনির্বাচিত মেয়র খায়রুজ্জামান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এই বিজয় উন্নয়নের জন্য চেয়ে থাকা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। কারণ, রাজশাহী শহরের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিলেন।

নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৩৮টি ভোটকেন্দ্রে গড়ে ৭৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। ৭৬টি কেন্দ্রে ৭৯ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ১১টি কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে নগরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। মোসাদ্দেক হোসেন একটি কেন্দ্রেও জিতেননি।

সবচেয়ে কম ৪২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট পড়েছে রাজশাহী স্যাটেলাইট টাউন হাইস্কুল কেন্দ্রে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী এই কেন্দ্রের ভোটার। সে কারণে সকাল থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা এই কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন। দুই দলের পোলিং এজেন্টরাও কেন্দ্রের সব বুথে ছিলেন। মোসাদ্দেক হোসেন সকালে ভোট না দেওয়ায় তিনি কখন আসেন, দিনভর তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন সাংবাদিকেরা। ফলে ক্ষমতাসীনরা বা প্রশাসনের লোকজনের এখানে কোনো ধরনের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা ছিল না। এই ভোটকেই প্রকৃত ভোটার উপস্থিতি হিসেবে দেখছেন স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের অনেকে।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে, ভোটের আগের দিন রাতেই প্রশাসনের সহায়তায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার কেটে বাক্সে ঢোকানো হয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়েও ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। আটকোষী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ কয়েকটি কেন্দ্রের সামনে ভোটাররা বিক্ষোভও করেছেন।

মোসাদ্দেক হোসেনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিনু প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে আসা ১২০ জন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে গত ২৯ জুলাই রাতে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ভোট বাক্সে ভরে দেওয়া হয়। যে কারণে অনেক কেন্দ্রে মেয়রের ব্যালট কোথাও ১১টায়, কোথাও ১২টা, আবার কোথাও ২টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

তবে খায়রুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি এ ধরনের অভিযোগ করছেন, তাঁর কাছে অকাট্য প্রমাণ থাকলে নিশ্চয়ই হাজির করতেন। তা ছাড়া রাতে ব্যালট বাক্স ভরানো আমাদের প্রয়োজনও ছিল না। কারণ এমনিতেই নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।’

আওয়ামী লীগ প্রার্থী যে বিজয়ী হবেন, আগে থেকেই এমন একটা ধারণা শহরবাসীর মনে তৈরি হয়েছিল। শুরু থেকেই শহরে একচেটিয়া প্রচার, স্থানীয় নানা সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা এবং রাষ্ট্রীয় নানা সংস্থা ও প্রশাসনিক আনুকূল্য মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মাতে সাহায্য করেছে।

অন্যদিকে প্রচারে, কর্মী সংগঠনে অনেকটা এর বিপরীত চিত্র ছিল মোসাদ্দেক হোসেনের বেলায়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান, সড়ক, দেয়ালে তাঁর পোস্টার-ফেস্টুন লাগানোর সুযোগই ছিল না। নেতা-কর্মীদের গা বাঁচিয়ে প্রচার চালাতে হয়। আবার শুরু থেকেই মোসাদ্দেক হোসেনের ভোট কারচুপির আশঙ্কা সমর্থকদের মধ্যে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে।

বিএনপি অভিযোগ করে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তাদের ১৫০ নেতা-কর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করে। সম্ভাব্য পোলিং এজেন্ট এবং সক্রিয় নেতা-কর্মীদের ভয় দেখিয়ে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। এর প্রভাব পড়েছে ভোটে। অনেকে এজেন্ট হতে অনাগ্রহ দেখান, কাউকে কাউকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, আবার অনেককে কেন্দ্রেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের শহর থেকে ধরে পাবনায়, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে চালান দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীরা কেন ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না!

নানা প্রতিকূল অবস্থার পাশাপাশি নির্বাচনের পর রাজশাহী বিএনপির একতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে কথা উঠেছে। অনেকে বলছেন, মোসাদ্দেক হোসেন অনেকটা একা হয়ে পড়েছিলেন। এর কিছুটা সত্যতা মেলে বিনোদপুরের ইসলামীয়া কলেজ কেন্দ্রের মাঠে তাঁর চার ঘণ্টা অবস্থানের সময়। তখন বৃষ্টি নামলে তিনি মাঠে একাই বসে ছিলেন। ছাতা ধরার মতো কোনো নেতা-কর্মীও পাশে ছিলেন না। পাশে টিনের ছাউনির নিচে একটি বেঞ্চের ওপর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমানকে বসে থাকতে দেখা যায়। এই কেন্দ্রে মোসাদ্দেক হোসেন ৪৩৩ আর খায়রুজ্জামান ১ হাজার ৪৬৯ ভোট পান।

মোসাদ্দেক হোসেনের পাশে না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘এসব বাজে কথা’। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমরা সব নেতা সমন্বিতভাবে একসঙ্গে কাজ করেছি। কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে ঝুঁকি নিতে চাননি। নানা ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে পাশে ছিলেন না। এই চিত্র শুধু রাজশাহীতে নয়, সারা দেশেই আছে।’

সার্বিক বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনপূর্ব ধরপাকড় ভোটে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, এটা নিয়ে কথা হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, মানুষ স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে নগরীর উন্নয়নকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।’

{প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন শিশির মোড়ল, সেলিম জাহিদ ও আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ}