'প্রতিশোধের' ধর্মঘটে সারা দেশে ভোগান্তি

যশোর থেকে গতকাল কোনো বাস ছাড়েনি। দুপুরে যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে। প্রথম আলো
যশোর থেকে গতকাল কোনো বাস ছাড়েনি। দুপুরে যশোর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে। প্রথম আলো
>
  • শহর ও দূরপাল্লার বাস বন্ধ 
  • রাতেও বাস চলাচল বন্ধ
  • ছাত্র আন্দোলন বন্ধ হলে বাস চলবে
  • এ ধর্মঘট আইনের লঙ্ঘন

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে শ্রমিকদের রাস্তায় নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল পরিবহনমালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিন্তু সরকারের সায় না পেয়ে তারা বেআইনিভাবে অঘোষিত ধর্মঘটের পথ বেছে নেয়। ‘প্রতিশোধের’ এই ধর্মঘটে সারা দেশের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে।

অতীতেও পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা ঘোষণা ছাড়া ধর্মঘট ডেকে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলেছিল। মোটরযান আইন ও শ্রম আইনে যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

এদিকে সরাসরি শ্রমিক নামিয়ে ছাত্রদের মুখোমুখি করায় সরকারের সায় না থাকলেও এই অঘোষিত ধর্মঘটে তাদের প্রচ্ছন্ন সায় আছে বলে জানা গেছে। কারণ, শ্রমিক ও ছাত্ররা মুখোমুখি হোক—এটা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চান না।

পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে আছেন সরকারের দুই মন্ত্রী ও এক নেতা। মূলত তাঁরাই পরিবহন খাতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। অঘোষিত ধর্মঘটেও তাঁদের ইশারা ছিল।

পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এসব পরিস্থিতিতে এক হয়ে মাঠে নামে। আর এসব ক্ষেত্রে মূল নেতৃত্ব দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনই শ্রমিকদের দিয়ে প্রথমে বাস বন্ধের উদ্যোগ নেয়। মালিকেরাও এই উদ্যোগে শামিল হন। সারা দেশের মালিক সমিতিগুলোর নেতৃত্বে আছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবহনমালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা তাদের নিজ নিজ সমিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক করেননি। তিন-চারজন মিলেই পুরো পরিবহন খাতের সব সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।

গাবতলীভিত্তিক পরিবহনমালিক সংগঠনের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দূরপাল্লার পথে তাঁরা বাস বন্ধের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু শাজাহান খান আর এনায়েত উল্যাহ বন্ধ করার কথা বললে অন্যদের আর কিছু করার থাকে না। আর এটা তো বোঝাই যায় যে বাস বন্ধ রাখার বিষয়ে সরকারের সায় আছে। ফলে লোকসান গুনেও বাস বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র আন্দোলন এখন আর স্বাভাবিক পথে নেই। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র ঢুকে গেছে। বাস বন্ধ রাখা এবং কবে চালু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যখনই আন্দোলন বন্ধ হবে, তখনই বাস চলাচল শুরু করবে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত রোববার থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। গত বুধবার নিজেদের নিরাপত্তার দাবি তুলে নারায়ণগঞ্জে পরিবহনশ্রমিকেরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাও করে তারা। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শ্রমিকদের মাঠে না নামানো এবং পুলিশকে সহনীয় আচরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরদিন থেকেই পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা অঘোষিত ধর্মঘট শুরু করেন। এতে ঢাকার গণপরিবহনসহ দূরপাল্লার সব বাস বন্ধ হয়ে যায়।

এর মধ্যে ঢাকার আশপাশে কিছু বাস চলাচল করলে গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে শ্রমিকেরা অবস্থান নিয়ে তা বন্ধ করে দেন। নগরীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে শ্রমিকেরা ধর্মঘট নিশ্চিত করছেন।

তবে পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত সূত্র এ-ও বলেছে, সারা দেশে ছাত্ররা চালকের লাইসেন্স এবং গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করা শুরু করায় অনেক চালক ও মালিক বাস বন্ধ রাখতে শুরু করেন। কারণ, তাঁদের কাগজপত্র ঠিক নেই।

সরেজমিনে গতকাল দুপুরে গাবতলী বাস টার্মিনালের ভেতরে ও রাস্তায় প্রচুর দূরপাল্লার বাস দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়। আমিনবাজার থেকে সাভার পর্যন্ত বিভিন্ন সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ও পেট্রলপাম্পে এবং রাস্তার পাশে বাস ফেলে রাখা হয়েছে।

এখন রাজধানীতে চলাচলের একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও কার। ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং ছোট ট্রাকে লোকজনকে যাতায়াত করতে দেখা গেছে। এসব যানবাহনে বিপুল ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের।

গতকাল দুপুরে গাবতলীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠার সময় কথা হয় সাভারের বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাভার থেকে ১৫০ টাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় এসেছেন। এখন নিউমার্কেটে যেতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করেছেন ৩০০ টাকায়। সময় অপচয় হচ্ছে, টাকাও গচ্চা যাচ্ছে। ফিরবেন কীভাবে, সেই শঙ্কাও আছে।

জানতে চাইলে খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এর মধ্যে ৪০০ বাস-মিনিবাস ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে আটটিতে। পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। ফলে রাতে বাস চালু রাখার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা-ও বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। সরকার সে ন্যায্য দাবি মেনে নিয়েছে। এখন এই আন্দোলনে থেকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের তৎপরতা শুরু হয়েছে। তাই এখন তাদের পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে হবে। তাহলেই পরিবহন চালু হবে।

এভাবে ধর্মঘট করা যায় না

মোটরযান আইনে বাস-মিনিবাসের অনুমতির অন্যতম শর্ত হচ্ছে গাড়ি চলাচল নিয়মিত অব্যাহত রাখা। চলাচল বন্ধ রাখতে হলে কর্তৃপক্ষকে আগে জানাতে হবে। হঠাৎ কোনো বাস নষ্ট হলে সেটাও জানানোর নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা সড়কে চলাচলের অনুমতির (রুট পারমিট) শর্তের লঙ্ঘন। এর সর্বোচ্চ শাস্তি রুট পারমিট বাতিল।

গত বছর আদালত একজন চালককে যাবজ্জীবন, আরেকজনকে মৃত্যুদণ্ড দিলে পূর্বঘোষণা ছাড়াই বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকেরা। সেবার নৌমন্ত্রীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসায় বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই বছর ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাস এবং সিটিং সার্ভিস বন্ধে অভিযান চালায় সরকার। তখনো ঘোষণা ছাড়াই বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকার অভিযান বন্ধ করার পর পুনরায় বাস চালু করেন মালিক-শ্রমিকেরা।

শ্রম আইন অনুসারে, মালিকেরা ধর্মঘট ডাকতে পারেন না। তাঁরা নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে ‘লে অফ’ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অন্তত ১৫ কর্মদিবসের আগে শ্রমিকদের অবহিত করতে হবে এবং মজুরি দিয়ে দিতে হবে।

আর শ্রমিকেরা কোনো দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ডাকলে অন্তত ১৫ কর্মদিবসের আগে আলটিমেটাম দিতে হবে এবং সরকারকে তা অবহিত করতে হবে। কিন্তু বাস-মিনিবাস মালিক-শ্রমিকেরা এর কোনোটাই মানেন না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে চালকেরা বাস চালাতে চাইছেন না। মালিকেরাও বাস বন্ধ রাখার পক্ষে। এটা আসলে ধর্মঘট নয়। মালিক-শ্রমিকেরা চালাতে চাইছেন না।