দুদকও আড়ি পাতছে ফোনে

টেলিফোনে আড়ি পাতার বিষয়টি এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অনেক বিষয়ই এর মাধ্যমে জনসমক্ষে চলে আসছে। অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। এসবের মধ্যেই আড়ি পাতার ক্ষমতা পেয়ে তা প্রয়োগ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা দল।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, এখনো এ-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি তাদের হাতে না এলেও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সহায়তায় কাজটি শুরু করেছে তারা। সম্প্রতি দুদক কার্যালয়ে এক সভায় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংস্থার চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের বৈঠকে সন্দেহভাজন এক ব্যক্তি সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য তুলে ধরা হয়। উপস্থাপিত ওই সব তথ্য পর্যালোচনা করে গোয়েন্দা বিভাগকে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।

সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গতিবিধি অনুসরণ, তাদের কথোপকথন রেকর্ড, চলাফেরা ও পলাতক আসামির অবস্থান শনাক্ত করতে গত ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মোবাইল ট্রেকিং প্রযুক্তি ব্যবহার করার অনুমতি পায় দুদক। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে এ-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি না থাকলেও এনটিএমসির মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে সংস্থাটি। তবে শিগগিরই তাদের যন্ত্রপাতি আসছে বলে জানা গেছে।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ট্র্যাকিংয়ের কাজটি পুরোপুরিভাবে শুরু করতে হলে আরেকটু সময় লাগবে। কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক লাগবে, যন্ত্রপাতি লাগবে। আপাতত এনটিএমসির নীতিমালা অনুযায়ী বিষয়টি চলবে।

দুদক সূত্র জানায়, বর্তমান কমিশন চায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ও ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) আদলে কমিশনকে পরিচালনা করতে। কিন্তু অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলা তদন্তের জন্য তথ্য সংগ্রহ-যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়। নির্ভুল অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য নিজস্ব গোয়েন্দা দলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে থেকেই আড়ি পাতার কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি।

বর্তমানে দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে আড়ি পাতার ক্ষমতা আছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সেনা গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাবের হাতে মোবাইল ট্রেকিং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। এখন দুদক সে ক্ষমতা পেল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইউ) শিগগির এ ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে টেলিযোগাযোগ আইনের ক্ষমতাবলে ‘আইনগতভাবেই’ টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। আইনটির ৯৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, ধারণ বা এ-সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহে সরকার সময়-সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থাকে কোনো ক্ষমতা দিতে পারবে।’

আইনে ‘সরকার’ বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমেই এ ধারা প্রযোজ্য হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের টেলিযোগাযোগ আইন করা হয়। তখন প্রণীত আইনে এ ধারা ছিল না। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আইনের সংশোধন করে এ ধারা যোগ করা হয়। এ আইন অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে এনটিএমসি গঠন করা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব এর প্রধান। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই এনটিএমসি কাজ শুরু করেছে।

বছর দুয়েক আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা-কর্মীর টেলিফোন সংলাপ আন্তর্জালে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার টেলিফোন আলাপও চলে আসে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে। তখনই প্রশ্ন ওঠে, এনটিএমসি থাকার পরও কীভাবে এসব টেলিফোন কথোপকথন প্রকাশ্যে আসে।

দীর্ঘদিন ধরেই আড়ি পাতার বিষয়টির অপপ্রয়োগ নিয়ে চিন্তিত আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁদের মতে, বেআইনি বা অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আড়ি পাতা গ্রহণযোগ্য নয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আড়ি পাতার মতো বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে বিরোধী মতকে দমন করার জন্য। সংবিধান তার নাগরিকদের যোগাযোগের গোপনীয়তার যে রক্ষাকবচ দিয়েছে, সেটা প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করা হচ্ছে এর মাধ্যমে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার যাতে লঙ্ঘন করা না হয়, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে।

তবে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আড়ি পাতার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী থাকলেও সেখানে নাগরিকের সুরক্ষা প্রাধান্য পায়। নাগরিকেরা নিশ্চিত থাকেন, তাঁদের তথ্যের কোনোরূপ অপব্যবহার হবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অনেক ক্ষেত্রেই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। যেসব তথ্য নেওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সেখানে ওই সব তথ্যের অপব্যবহার করা হয়।’ আড়ি পাতার ক্ষমতা ‘সহজলভ্য’ করে দেওয়ার সমালোচনা করেন তিনি।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে কমিশনের লিখিত অনুমোদন ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা যাতে ক্ষুণ্ন না হয় এবং বলার স্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়, সেটা আমি নিজে নিশ্চিত করতে চাই। তবে যাঁদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কিংবা জনশ্রুতি আছে, তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে কমিশনের গোয়েন্দারা কমিশনের অনুমতি নিয়ে এ কাজ করবেন।’

আড়ি পাতার বিষয়টি নিয়ে দুনিয়াব্যাপী রয়েছে বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া আড়ি পাতা আইনত নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সিনেটরদের নিয়ে গঠিত সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি তো আছেই।

টেলিফোনে আড়ি পাতার ঘটনায় ১৯৭৪ সালে বিশ্বব্যাপী আলোচিত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনের টেলিফোনে আড়ি পাতার জন্য রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। ১৯৯০ সালে ভারতের সমাজবাদী জনতা পার্টি নেতা চন্দ্রশেখরের টেলিফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছিল। তখন তাঁর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথাবার্তা চলছিল। অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।

আড়ি পাতার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হলেও সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজ ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকেই আসে। সরকারের ভেতরেই আড়ি পাতার বিষয়টি নিয়েও একবার ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিটিআরসির একটি সূত্রমতে, ২০১০ সালে একটি গোয়েন্দা সংস্থা মন্ত্রী ও সরকারদলীয় কয়েকজন নেতার মোবাইলে আড়ি পেতে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠায়। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে হইচই পড়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে সরকার জানতে পারে, আড়ি পাতার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগোচরেই হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোয়েন্দা সংস্থা নিজের মতো করেই আড়ি পাতার কাজটি করেছিল।

পরে ওই বছরের ৭ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কার্যপত্রে বলা হয়, রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার স্বার্থে আড়ি পাতার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই নিয়ন্ত্রণ করবে।

২০১৪ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সন্ত্রাস দমন-সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরির জন্য জাতিসংঘের বিশেষভাবে নিয়োজিত মানবাধিকার আইনজীবী বেন এমারসন একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাপক আড়ি পাতা প্রযুক্তি অনলাইন গোপনীয়তার নির্বিচার লঙ্ঘন। এটি জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার মূল বিষয়বস্তুর ওপর আঘাত। ঘোষণার ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তাঁর সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না।

এর আগে ওই বছরের জুলাই মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই আরেকটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আড়ি পাতা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে সমালোচনা করেছিলেন নাভি পিল্লাই।