তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি নিয়ে কী পেলেন তাঁরা?

তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পাওয়া হিজড়া জনগোষ্ঠী। প্রথম আলো ফাইল ছবি
তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পাওয়া হিজড়া জনগোষ্ঠী। প্রথম আলো ফাইল ছবি

চলার পথে বা পাবলিক বাসে তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে দেখলে অনেকে আঁতকে ওঠেন। কেউ ভয় পান। কেউবা আবার বিরক্তি প্রকাশ করেন। ঝামেলা এড়াতে অনেকে তাঁদের চটজলদি টাকা দিয়ে কেটে পড়েন। টাকা দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের সঙ্গে কারও কারও রীতিমতো ঝগড়াবিবাদও লেগে যায়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টাকা চেয়ে বা জোর করে আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা যায় তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের। এমনকি চাঁদাবাজি ও যৌনাচার করার অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। ফলে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের প্রতি সাধারণ মানুষের অবহেলা ও বৈষম্যও লক্ষণীয়। তাই বৈষম্য দূর করতে ও সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে চারটি বছর। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি নিয়ে কী পেলেন তাঁরা?

জবাবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংগঠন ‘সুস্থ জীবন’-এর নির্বাহী পরিচালক ববি হিজড়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সবকিছু পাওনা আছে। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির পর সরকার শুধু ৫০ বছর ও এর বেশি বয়সের হিজড়াদের মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দিচ্ছে। তবুও সেটা সবাই পাচ্ছে না। বলতে গেলে আমরা কিছুই পাইনি।’

পরিবহনে চলাচল করা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা চাইছেন তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
পরিবহনে চলাচল করা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা চাইছেন তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ববি হিজড়া বলেন, ‘সরকার আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ডাকা হচ্ছে, আলোচনা করা হচ্ছে। কীভাবে হিজড়াদের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু অগ্রগতিটা কোথায়, তা বুঝতে পাচ্ছি না।’

রাজধানীর হাতিরঝিলের পাশে মধুবাগ এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের একটি জমায়েতস্থল আছে। সেখানে সম্প্রতি সরেজমিনে জানা যায়, আধা পাকা ঘরে আশপাশ এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রায় প্রতিদিন সমবেত হন, আড্ডা দেন এবং সারা দিনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেন। কে কোন এলাকায় টাকা তুলতে যাবেন, সেটাও এখান থেকে নির্ধারণ করা হয়। ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল সেখানে যাতায়াত করে। তাদের একজন সর্দারনি আছেন। তিনি কিছুদিন পরপর এখানে আসেন।

সম্প্রতি দুপুরে আধা পাকা ওই ঘরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের ১০ থেকে ১২ জন একসঙ্গে খেতে বসেছেন। খাওয়ার পরে কথা বলবেন বলে জানান। খাওয়া শেষ গিয়ে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ তাঁরা দেননি। জানতে চাইলে ঝিলমিল নামের তৃতীয় লিঙ্গের একজন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার যে তাঁদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে, তা তিনি জানেন না। তবে তাঁর স্মার্টকার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) আছে। আরেকজন বলেন, ‘সরকার আমাদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়ে কর্মসংস্থানের কথা বলেছিল, কিন্তু আমাদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। কাজ দিলে কি আর এখনো বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কাছে হাত পাতি?’

২০১৫ সালের ১৯ মে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে এক বৈঠকের সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আগামী বছর (২০১৬) থেকে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে হিজড়াদের নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’ এই ঘোষণার পরও দুই বছর পার হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি বলে দাবি করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন। অবশ্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তাঁদের কল্যাণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এখন স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে (প্রাথমিকে জনপ্রতি মাসিক ৭০০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চমাধ্যমিকে ১০০০ ও উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের যাঁদের বয়স ৫০ বা এর বেশি, এমন অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের মাসিক ৬০০ টাকা করে বিশেষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে তাঁদের সমাজের মূল স্রোতোধারায় আনার কাজ চলছে। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মিলে এক যুবকের হাতে নকশা এঁকে দেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মিলে এক যুবকের হাতে নকশা এঁকে দেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের বর্তমান পরিস্থিতি
তৃতীয় লিঙ্গের অনেক লোকজনের এসব কর্মসূচির বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। তবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি বিষয়ে অনেকের জানা থাকলেও অধিকার ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁরা বলছেন, স্বীকৃতির চার বছর পর তাঁরা শুধু স্মার্টকার্ড পেয়েছেন। নিজস্ব পরিচয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। প্রাপ্তির মধ্যে এটুকুই। আগেও তাঁরা মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টাকা তুলে জীবিকা নির্বাহ করেছেন, এখনো সেটাই করছেন। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির পর তাঁদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাঁরা সমাজের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলে মনে করেন। তা ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের বেশির ভাগ শিক্ষিত নন। সে ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার নির্ধারণে জটিলতা রয়েছে। তবে যাঁরা শিক্ষিত রয়েছেন, তাঁদের চাকরি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।

তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনকে নিয়ে কাজ করা বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার উম্মে ফারহানা জেরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির পর তাঁদের প্রাপ্তি একদাগে বলা মুশকিল। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি অব্যাহত রয়েছে, যার দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে গেলে আরও সময় প্রয়োজন। তবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নবিষয়ক প্রশিক্ষণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্তি, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে হিজড়াদের জন্য তৃতীয় বক্স সংযুক্তি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।’

উম্মে ফারহানা জেরিফ বলেন, ‘সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হিজড়াদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁদের যে পরিমাণ বেতন ধার্য করা হয়েছে, তা জীবিকার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এতে চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। এই ধরনের পরিস্থিতি সমাজে অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে হিজড়ারা চাকরি করতে ইচ্ছুক নন। আসলে এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ দরকার এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

মধুবাগ এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মাস্টার্সে পড়ুয়া ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসীর। তিনি বলেন, ‘রাস্তাঘাটে চলার পথে প্রায়ই হিজড়ারা সামনে পড়ে। নানা অঙ্গভঙ্গির কারণে আমি তাদের ভয় করি, তাদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’ তাঁর মতো অনেকেই তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনকে ভয় পান। অবশ্য কেউ কেউ তাঁদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা ও ব্যঙ্গবিদ্রূপও করেন। তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেও দেখা যায়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। তবে বাস্তবতা প্রতিবন্ধকতামূলক। ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ভুল ধারণা, তা দূর করতে হবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের ১১ হাজার মানুষ রয়েছেন। তবে তাঁরা বলছেন, এই সংখ্যা লাখের ওপরে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেন।

গত বছর প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে এসে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সরকারের নানা কর্মসূচির বিষয় উল্লেখ করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নুরুল কবির বলেন, তাঁদের জন্য ৬০০ টাকার বিশেষ ভাতা রয়েছে। ৫০ বছর বয়স্ক ব্যক্তিরা এ ভাতা পান। সারা দেশে কমবেশি ১১ হাজারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ জনকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দেশের ৩৮টি জেলায় ৫০ জন করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন কর্মসংস্থানের জন্য।