শ্রীপুরের তারা মিয়া বাঁশের টুকরি তৈরি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন

৩০ বছর ধরে বাঁশ দিয়ে টুকরি বানান তারা মিয়া। ছবি: প্রথম আলো
৩০ বছর ধরে বাঁশ দিয়ে টুকরি বানান তারা মিয়া। ছবি: প্রথম আলো

শান্ত এক গ্রাম। সবুজের বুক চিরে মেঠোপথগুলো এঁকেবেঁকে চলে গেছে গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুঁয়ে। পাখির কলকাকলি আর কৃষকের হাঁকডাকে মুখর এলাকা। যান্ত্রিক কোনো শব্দ নেই। এমন শান্তসুনিবিড় গ্রামে নিজ বাড়ির সামনে নিবিষ্ট মনে বসে বাঁশ দিয়ে টুকরি (বাঁশের খাঁচা/ঝাঁপি) তৈরি করছেন তারা মিয়া নামের ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা তেলিহাটি ইউনিয়নের তালতলি গ্রামের দৃশ্যপট এটি।

লম্বাটে গড়নের তারা মিয়া সদাহাস্যোজ্জ্বল চেহারার একজন মানুষ। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি এ পেশায় সংযুক্ত রেখেছেন দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে। বাঁশ ঝাঁপিতে প্রতিদিন নিজের স্বপ্ন বোনেন তিনি। গাজীপুর ও এর আশপাশ, এমনকি ঢাকা শহরের কিছু জায়গায় তাঁর তৈরি টুকরি ব্যবহার করা হয়। তাঁর তৈরি টুকরি পাইকারেরা কিনে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন। তা ছাড়া তিনি নিজেও স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি করেন।

গত বৃহস্পতিবার তারা মিয়ার বাড়ির সামনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ক্যামেরা ক্লিকের শব্দে সংবিৎ ফিরে তাকান নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাওয়া তারা মিয়া। ‘কেমন আছেন’—এমন প্রশ্নে রাজ্যের সুখের হাসি হেসে বলেন, ‘আমি ভালো আছি, আপনেগরে তো চিনলাম না।’ পরিচয় পেয়ে সে কী বিনয় এই বৃদ্ধের! উনি সংবাদপত্র পড়েন না, কিন্তু বাড়ির পাশের টং ঘরে সন্ধ্যার পরের যে জমায়েত হয়, সেখানে তিনিও একজন মনোযোগী শ্রোতা। তাই পত্রিকা বা অনলাইন এই দুটোর কিছু ধারণা আছে তারা মিয়ার। বয়স জিজ্ঞেস করতেই তিনি সহাস্যে বললেন, ৬০-৬৫ বছর হবে হয়তো।

ঠিক যেখানটায় তিনি বাঁশের টুকরি বুনে যাচ্ছিলেন, সেখান থেকে কিছুটা সরে এসে প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে সময় নিয়ে বলতে থাকলেন তাঁর জীবনের কথা। ছোট থেকেই নিজের পরিবারের কয়েক সদস্যকে তিনি বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে দেখেছেন। বংশপরম্পরায় তারা মিয়া নিজেও এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাঁর পূর্বসূরিরা টুকরি ছাড়াও অন্যান্য আসবাবপত্র বানাতেন। তিনি বলেন, ‘এখন তো বয়স হয়ে গেছে, তাই প্রতিদিন দুই-তিনটি ঝাঁপি তৈরি করতে পারি।’

তারা মিয়া জানান, একটি টুকরির দাম মানভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। বাঁশ জোগাড় করতে হয় পাশের গ্রাম থেকে। নিজের গ্রাম থেকেও মাঝে মাঝে তিনি বাঁশ সংগ্রহ করেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। নিজের সন্তানকে এই কাজ শিখিয়েছেন কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তারা এই কাজ করতে চায় না। আমিও চাই না কষ্টের কাজ তারা করুক। লেখাপড়া করে মানুষ হোক। এখন আমার সন্তান দুজনই লেখাপড়া করে।’ প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকার ঝাঁপি বিক্রি করতে পারেন তিনি। তবে কোনো কোনো দিন বিক্রি এতই কম হয় যে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে যায়।

তালতলি গ্রামের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের আরও ১০ থেকে ১২ জন এই কাজের সঙ্গে জড়িত।

তারা মিয়া জানান, বেতের টুকরি তৈরি করে তা বাজারজাত করে নিজের সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন এই আয় থেকেই। ছেলে কলেজে আর মেয়ে স্কুলে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই পরিবারে বেতের ঝাঁপি তৈরির প্রজন্ম হয়তো লোপ পাবে। এরপরও তিনি চান, সন্তানেরা শিক্ষিত হয়ে ‘ভালো আয়ের’ পেশায় জড়িত হোক। বাঁশের ঝাঁপিতে সেই স্বপ্নই বুনে যাচ্ছেন তিনি। যা আয় হয়, তা দিয়ে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় শ্রম দিয়ে চলেছেন।