বারবার ধরা পড়ে আর ছাড়া পায় জঙ্গিরা


(২১ আগস্ট, ২০০৫ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন। বানানরীতি ও অন্যান্য বিষয় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)

কয়েক বছরে পাঁচ শতাধিক জঙ্গি গ্রেপ্তার হলেও প্রশাসনের নমনীয় ভূমিকার সুযোগে বাংলা ভাইসহ জঙ্গিবাদের সমর্থকরা ছাড়া পেয়ে গেছে। এবারও প্রশাসনের নমনীয় ভূমিকায় ও আইনের ফাঁক গলে এসব দুষ্কৃতকারী ও তাদের মাথারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে কি না সে সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানা যায়, জামাআতুল মুজাহিদিনের উত্তরাঞ্চলীয় অপারেশনাল কমান্ডার কথিত জাগ্রত মুসলিম জনতার নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ২০০২ সালের ১৭ আগস্ট বাগেরহাটের মোল্লাহাটে ১২ সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। কিন্তু মামলায় নাম বাদ দেওয়ায় সে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর ২০০৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাট জেলগেটে বাংলা ভাই তার দুই সহযোগীসহ আরেক দফা গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু পুলিশ তখন তাকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করে আদালতে দুর্বল প্রতিবেদন দাখিল করে। কয়েক দিন পরই বাংলা ভাই মুক্তি পায়। বাংলা ভাই মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির কথা স্বীকার করে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল আজাদ চৌধুরী এ প্রতিবেদককে (গত ৯ আগস্ট) বলেন, এ ঘটনায় দায়ী পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তিনি বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন। এরপর থেকে বাংলা ভাই আর ধরা পড়েনি। বরং গত বছর বেশ কিছু দিন সরকার দাবি করেছিল, এ নামে কেউ নেই।
গত ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার পর সারা দেশে জঙ্গি সন্দেহে এ পর্যন্ত ১২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে গত ছয় বছরে বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের পাঁচ শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হলেও এদের প্রায় সবাই মুক্তি পেয়ে গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের না করা, সুষ্ঠু তদন্তের অভাব ও পুলিশের অবহেলা এবং তাদের একাধিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাই এসব ভয়ঙ্কর অপরাধীর মুক্তি পাওয়ার প্রধান কারণ। ঘুরেফিরে একই জঙ্গি সদস্য একাধিকবার বিভিন্ন এলাকায় গ্রেপ্তার হয়েছে এবং আবার বেরিয়ে গেছে।
২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট জয়পুরহাটের উত্তর মহেশপুরে জঙ্গিরা অতর্কিতে পুলিশের টহল দলের ওপর হামলা চালিয়ে ৩টি শটগান, ২২ রাউন্ড গুলি ও একটি বেতারযন্ত্র (ওয়াকিটকি) ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ জামাআতুল মুজাহিদিনের নানা কাগজপত্রসহ ৪২ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। তবে পুলিশের লুট করা অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এই ৪২ জনের মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদিনের শীর্ষনেতা শায়খ আবদুর রহমানের ছোট ভাই আতাউর রহমান, বাংলা ভাইয়ের দেহরক্ষী বগুড়ার কার্ণিপাড়ার রাসেলও গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরে এই ৪২ জনের সবাই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। এদের মধ্যেই একজন ছিল দিনাজপুরের রাজারহাটের আনোয়ার শাহাদাত। এই শাহাদাত ২০০৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর শহরের ছোট গুড়গোলার মেসে বোমা বিস্ফোরণ মামলার প্রধান আসামি।
৪২ জনের আরেকজন সাঘাটা উপজেলার বারকোনা আবদুল্লাহপাড়ার আনিসুর রহমান। সে ২০০৪ সালের ১২ নভেম্বর অপর সহযোগী আমজাদ হোসেনসহ বোনারপাড়া রেলস্টেশনে ২৪টি টাইম বোমা ও ১২৪টি ডেটোনেটরসহ গ্রেপ্তার হয়। তখন স্বীকার করেছিল, বোমা বানাতে দক্ষ জামাআতুল মুজাহিদিনের একজন সদস্য সে। পুলিশকে সে আরো বলেছিল, বগুড়ায় মমতাজের গানের অনুষ্ঠানে হামলার জন্য সে বোমাগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। এ মামলাটির কোনো অগ্রগতি নেই। উপরন্তু তার সহযোগী আসামি আমজাদ জামিনে বেরিয়ে গেছে।
উত্তর মহেশপুরে ধরা পড়াদের আরেকজন মাসুদুর রহমান রানু গত ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলার ঘটনায় আবার গ্রেপ্তার হয়েছে। রানু ২০০২ সালে কালাই উপজেলা সদরে বন বিভাগের দেয়ালে জামাআতুল মুজাহিদিনের নামে ‘দেয়াল লিখতে’ গিয়ে আরো ছয়জনসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল।
২০০০ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল রাউতনগর আহলে হাদিস মসজিদ থেকে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় প্রশিক্ষক গাইবান্ধার ফজলে রাব্বী ও রানীশংকৈলের লুত্ফর রহমান নামে জামাআতুল মুজাহিদিনের দু সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ফজলে রাব্বী ও লুত্ফর রহমান ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফা গ্রেপ্তার হয়। তখন তাদের ঢাকায় যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে নেওয়া হলেও অল্প কয়েক দিন পরই তারা জামিন পায়। ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার পর উল্লিখিত লুত্ফরকে পুলিশ আবার গ্রেপ্তার করে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঠাকুরগাঁও আহলে হাদিসের একটি মসজিদ থেকে প্রশিক্ষণকালে পুলিশ তিন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তাদের স্বীকারোক্তিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি হরিপুর থানার চৌরঙ্গী বাজার আল-হারামাইন মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জামাআতুল মুজাহিদিনের প্রশিক্ষক মাওলানা আবদুর রহমানকে (বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে)। এরাও পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে যায়।
২০০৩ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় গ্রেপ্তার করা জামাআতুল মুজাহিদিনের সাত সদস্যকে ৫৪ ধারায় আটক দেখানো হয়। পরে পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে তারা বেকসুর খালাস পায়। এদেরই একজন সালাউদ্দিন গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে কালাই ব্র্যাক অফিসে বোমা হামলার ঘটনায় আবার ধরা পড়ে।
জয়পুরহাটের সিআইডি সূত্র জানায়, ২০০৩ সালের ১৬ এপ্রিল জামাআতুল মুজাহিদিনের সাত সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তাদের মধ্যে মাসুদ, রাজু ও সুজাউলকে কালাইয়ের বেগুনগ্রামের পীরের আস্তানায় পাঁচ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য তিন দফা আদালতে আবেদন জানানো হয়। কিন্তু ‘অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে’ তারা মুক্তি পেয়ে যায়।
বরিশালে হিজবুত তাওহিদ নেতা সোহরাব খান দু দফা ও মেহেরপুরে ২০০৩ সালের ১৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা একই সংগঠনের চার সদস্য মুক্তি পায়। তবে পুলিশের এজাহারে এ সংগঠনটিকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
গত বছর ৩০ জুন সকালে বরগুনার শিয়ালিয়া মসজিদে প্রশিক্ষণকালে গ্রামবাসীর সহায়তায় পুলিশ ৩৩ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। পরে ৪ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছয়জনকে অভিযুক্ত করে এবং বাকি ২৭ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এতে ২৭ জঙ্গিকে আদালত মুক্তি দেন। এদের মুক্তি দেওয়ার ছয় দিনের মাথায় অভিযুক্ত ছয় জঙ্গিও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পায়।
২০০২ সালের ২১ মে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার জাহানাবাদ বাজার পাড়ায় ২৫টি বোমা, জঙ্গিদের সদস্য তালিকা ও বেশ কিছু কাগজপত্রসহ কালো ইউনিফর্ম পরা আট জঙ্গি সদস্য গ্রেপ্তার হয়। এই মামলার ২৫ সাক্ষীর ২১ জনই পুলিশ। মামলার বিচারকালে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আসামিদের কাছে ২৫টি বোমা পাওয়া গেছে। কিন্তু গ্রেপ্তারকারী এসআই আদালতে দেওয়া তার সাক্ষ্যে বলেন, এদের কাছে ২৫টি বোতল পাওয়া গেছে। অন্য চার পুলিশ সদস্য বলে, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ২৫টি বোতলসদৃশ বোমা। এ ছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মামলায় সাক্ষী না করে প্রত্যক্ষদর্শী নয়-এমন বেশির ভাগ লোককে সাক্ষী করা হয়। ওই মামলার সব আলামত পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আদালতে পুলিশ বলেছে, থানার মালখানায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে আগুন ধরে সব আলামত নষ্ট হয়ে গেছে।
এ মামলার সব আসামি খালাস পেয়ে গেছে। এ ব্যাপারে দিনাজপুর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের পিপি গোলাম কবির বিন পার্ল প্রথম আলোকে বলেছেন, দুর্বলভাবে মামলা সাজানোর কারণেই জঙ্গিরা পার পেয়ে গেছে।
চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি রাতে নাটোর সদর থানার সাধুপাড়া আহলে হাদিস মসজিদ থেকে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা ১২ জঙ্গি সদস্যকে। তারা তাদের নেতা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসাদুল্লাহ আল গালিব ও আবদুর রহমানের নাম বলেছিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ওই মামলায় গালিবকে আসামি করা হলেও অদ্যাবধি তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি এবং নাটোরের আদালতে তাকে একবারও তোলা হয়নি। আমাদের নাটোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন (আসামিদের বাদ দেওয়া) দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি নাটোরের বড়াইগ্রামের গারফা বাজারে যাত্রামঞ্চে বোমা হামলা মামলায় ওই ১২ জঙ্গিকে আসামি করা হলেও গত ২৮ জুন এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। ফলে আসামিরা সবাই এ মামলা থেকে অব্যাহতি পায়।
জানা গেছে, দেশে প্রথম সশস্ত্র জঙ্গি সদস্য ধরা পড়ে ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন দুপুরে কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার পাইনখালী গ্রামসংলগ্ন লুণ্ডাখালীর জঙ্গলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণরত ৪১ জঙ্গি সদস্যকে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সামরিক পোশাকসহ গ্রেপ্তার হয়। এরা সবাই হরকাতুল জিহাদের সদস্য। পরে ১৯৯৮ সালের ৩ মে এ সংক্রান্ত মামলার রায়ে এসব জঙ্গির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও কিছু দিন পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে তারা বেরিয়ে যায়।
সূত্র মতে, ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে গত ছয় বছরে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সব সদস্য মুক্তি পেয়েছে। এদের ৫৭ জন বিভিন্ন সময়ে মামলা থেকে অব্যাহতিও পায়। জানা গেছে, এ সময় জামাআতুল মুজাহিদিন, হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাওহিদ, তাওহিদি জনতা ও শাহাদাতই আল-হিকমা-এ পাঁচ সংগঠনের ৪৩৫ জন সদস্য বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার হয়। এর মধ্যে’ ৯৮ সালে ৭৪ জন, ’ ৯৯ সালে তিন, ২০০১ সালে আট, ২০০২ সালে পাঁচ, ২০০৩ সালে ৭২,২০০৪ সালে ১২৬ এবং চলতি বছর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪৭ জন গ্রেপ্তার হয়। তবে এর পর গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের অনেকে এখনো কারাগারে আছে।
উত্তরাঞ্চলে কর্মরত পুলিশের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, জঙ্গি তত্পরতার খবরকে সরকার এত দিন ‘গণমাধ্যম’-এর অপপ্রচার কিংবা বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে আসছিল। জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও শরিক দলের নেতারা প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতেও এসব কথা বলে আসছিলেন। ফলে পুলিশও আটক জঙ্গিদের ব্যাপারে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস করেনি।
পুলিশের বিশেষ শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তারের পর এসব জঙ্গিকে পৃথক পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও সম্মিলিতভাবে এদের মূল চক্রটিকে শনাক্ত করার কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি।