২১ আগস্ট, ২০০৪: সে দিন যা ঘটেছিল

হতাহত লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা। ছবি: জিয়া ইসলাম
হতাহত লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা। ছবি: জিয়া ইসলাম

(২২ আগস্ট, ২০০৪ প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন)

অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে বক্তৃতা শেষে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত ট্রাক থেকে নামার মুহূর্তে তাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হতে থাকলে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা মানববর্ম হয়ে তাকে রক্ষা করেন। দলের নেতা-কর্মী ও দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যান। আর উপর্যুপরি বিস্ফোরণে মঞ্চ ও সমাবেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কমপক্ষে ১৬ জন নিহত এবং চার শতাধিক আহত হয়েছেন। এদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। 

নিহতদের মধ্যে দুজন নারী ও ১৪ জন পুরুষ রয়েছেন। মারা গেছেন মহানগর-মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সুফিয়া বেগম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব, দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাহারা খাতুন, শেখ হাসিনার গানম্যান সেলিম, নজরুল ইসলাম বাবুও গুরুতর আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি বিস্ফোরণ ঘটে। সভার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহূত ট্রাকের ওপর, এর পাশে, সমাবেশস্থলে এসব বিস্ফোরণ ঘটে। পরে সাংবাদিকরা সেখানে অবিস্ফোরিত অবস্থায় দুটি গ্রেনেড দেখতে পান। বিস্ফোরণের পর পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের চিত্কার, ছুটোছুটিতে একটি প্রাণবন্ত সমাবেশের চেহারা পাল্টে যায়। একটু থিতু হতেই দেখা যায়, আওয়ামী লীগ কার্যালয় আর রমনা ভবনের সড়কে জায়গায় জায়গায় রক্তের স্রোত। ছেঁড়া স্যান্ডেল, রক্ত, পড়ে থাকা ব্যানার, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নারী-পুরুষের দেহ-কেউ নিথর-স্তব্ধ, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে তুষার হত্যাকাণ্ড এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মী হত্যা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ গতকাল দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও গণমিছিল ডেকেছিল। সভা শুরু হয় বেলা সাড়ে ৩টার দিকে। বিকেল ৫টায় শেখ হাসিনা এসে সভাস্থলে পৌঁছান এবং ট্রাকে ওঠেন। এ সময় ট্রাকে তার সঙ্গে জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী. শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা-নেত্রী ছিলেন। ট্রাকের পাশেই নিচে ছিলেন ওবায়দুল কাদের, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতা-কর্মীরা।

সমাবেশের শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনার ভাষণ। ছবি: জিয়া ইসলাম
সমাবেশের শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনার ভাষণ। ছবি: জিয়া ইসলাম

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখতে শুরু করেন ৫টা ২ মিনিটে। ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই দক্ষিণ দিক থেকে কে বা কারা তাকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানববর্মের মতো চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেন। প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্য করে একই দিক থেকে পর পর আরো দুটি গ্রেনেড ছোড়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা দেহরক্ষী পুলিশরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন। স্টেডিয়ামের দিক হয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে সরিয়ে নেওয়া হয়। শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখনো একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একই সঙ্গে চলছিল গুলির শব্দ। এসব গুলি-গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে তা পরে বোঝা যায়। পরে শেখ হাসিনার বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে গিয়ে তাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির সামনে-পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের অবস্থা: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ, আহতদের চিত্কার, রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটিতে পুরো এলাকার চেহারা বদলে যায়। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়ার পর ট্রাক থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় নামতে থাকেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, তাদের ধরে নামানো হয়। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতা-কর্মী এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে যান। আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে ভেতরে নেওয়া হয়। অনেককে দেখা যায় পথে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দলীয় নেতা-কর্মীদের। এ অবস্থায়ই রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে বেশ কজন মহিলাও ছিলেন।
ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একদিকে যখন আহতদের উদ্ধার চলছিল, আরেকদিকে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় যানবাহনের ওপর হামলা করছিলেন। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সিটি ভবনসহ আশপাশের আরো কয়েকটি ভবনের জানালা-দরজা। বাস, মিনিবাস, গাড়ি-কর্মীরা সামনে যা পান তা-ই ভাঙতে থাকেন। ২০-২৫টি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী বাদে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত কোনো পুলিশ ছিল না। পুলিশ ছিল স্টেডিয়াম প্রান্ত এবং গোলাপ শাহ মাজারের কাছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দু এলাকা থেকেই পুলিশ ছুটে আসে এবং ঘটনাস্থল লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।

বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে আগুন দেয়। ছবি: জিয়া ইসলাম
বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে আগুন দেয়। ছবি: জিয়া ইসলাম

সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে যানবাহনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। রাস্তায় পড়ে আছে জমাট বাঁধা রক্ত, হতাহতদের শরীর থেকে বের হয়ে থাকা নাড়িভুঁড়ি, রক্তাক্ত দলীয় পতাকা-ব্যানার আর পরিত্যক্ত স্যান্ডেল। দলীয় কার্যালয়ের সামনে পেট্রলপাম্পের গলির মাথায় পড়ে আছে একটি তরতাজা গ্রেনেড। অদূরে আরেকটি। যেকোনো কারণেই হোক এগুলো বিস্ফোরিত হয়নি বা হামলাকারীরা ফেলে পালিয়েছে। আহতদের দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে বের করে ভ্যানে ওঠানো হচ্ছিল। মমিন নামে আহত এক আওয়ামী লীগ কর্মী ভ্যানে শুয়েই সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পারলেন না। এর আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। পাশের আরেকটি দোকান থেকে বের করে গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিল আহত আরো কয়েকজনকে। উদ্ধারকারীরাও আহতদের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে একাকার। ফলে পাশে দাঁড়িয়েও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না কে আহত আর কে উদ্ধারকর্মী। আহতদের চিত্কার, উদ্ধারকর্মীদের হৈচৈ আর বিক্ষোভকারীদের স্লোগানের শব্দে মিশে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। ৬টা ১০ মিনিটের দিকে দলীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কাজী জাফরউল্লাহ ও মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় হাসপাতালে।
আবারও গ্রেনেড বিস্ফোরণ: প্রথম গ্রেনেড হামলা ঘটে ৫টা ২২ মিনিটে। উদ্ধার অভিযান চলাকালে সন্ধ্যা ৬টা ২৬ মিনিটে প্রচণ্ড শব্দে আরেকটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই সিটি ভবনের পাশের গলিতে। এর পাশেই একটি গাড়ি জ্বলছিল। পুলিশ জানায়, আগুনের উত্তাপে এখানে পড়ে থাকা গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে সেখানে উপস্থিত কয়েকজন দলীয় কর্মী জানান, সিটি ভবন থেকে আবারও এটি নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফার এই বিস্ফোরণে আর কেউ হতাহত হয়েছে কি না তা তাত্ক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। কারণ যে সময় এটি বিস্ফোরিত হয় সে সময়ও আগের ঘটনায় আহতদের অনেককে উদ্ধার করা হচ্ছিল। ফলে কে আগের ঘটনায় বা কে পরে, তা নিশ্চিত করে বলা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস: ঘটনার পর উদ্ধার আর বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছিল একই সঙ্গে। কর্মীরা আহতদের উদ্ধার করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ও ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। একই সময় চলছিল আশপাশে ভাঙচুর। রাস্তায় গ্রেনেড পড়ে থাকায় বা পাল্টা আক্রমণের ভয়ে পুলিশ সরাসরি দলীয় কার্যালয়ের সামনে না গিয়ে দূর থেকেই বিক্ষুব্ধ কর্মীদের লক্ষ্য করে ঘন ঘন টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। এ সময় ছুটোছুটি শুরু হলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ চালায়। পুলিশের টিয়ার গ্যাস আর লাঠিচার্জ চলার কারণে এ সময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও তথ্য সংগ্রহে বিঘ্ন ঘটে। এ সময় একজন উপ-পুলিশ কমিশনারকেও রায়ট-কার নিয়ে টহল দিতে দেখা যায়। যেসব গাড়িতে আগুন জ্বলছিল, সন্ধ্যার দিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে আগুন নেভান।
উপস্থিত পুলিশের ভাষ্য: ঘটনাস্থল এবং অদূরে উপস্থিত ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ রকম দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, হামলাকারী যারাই হোক না কেন, তাদের টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা, এটি নিশ্চিত। এ ছাড়া হামলাটিও চালানো হয়েছে দক্ষিণের সিটি ভবন অথবা পাশের পেট্রলপাম্পের গলি থেকে।
ঘটনাস্থলে র‍্যাব-বিডিআর: ঘটনার পরপরই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) ও বিডিআর সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। বিডিআর ও র্যাবের কর্মকর্তারা উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ঘটনাস্থলে আসেন।
শহরে বিডিআর টহল জোরদার: গ্রেনেড হামলার পরই মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে নগরীর ২২টি থানা এলাকাতেই টহল ব্যবস্থা আরো জোরালো করার জন্য মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরই শুরু হয় নগরীর অলিগলিতে যানবাহন তল্লাশি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং স্পর্শকাতর স্থাপনার সামনে অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়ন করা হয়। উল্লিখিত এলাকায় বিডিআর টহলও জোরদার করা হয়।
অপর এক সূত্র জানায়, ঘটনার পর থেকে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের ওপরও কড়া নজর রাখতে শুরু করেছে। রাতে এসব হলে তল্লাশি চালানো হতে পারে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া পুলিশ ঘটনার পর থেকে ঘটনাস্থলের পাশের সিটি ভবনসহ আরো কয়েকটি ভবন ঘিরে রেখেছে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তারা সেখানে তল্লাশি চালানোর সাহস পাচ্ছিল না। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল।

শেখ হাসিনাকে হত্যার সব চেষ্টা করেছিল হামলাকারীরা
গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন তার সব চেষ্টায়ই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারা চিহ্ন এবং বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। নেত্রীর গাড়িতে হামলার ধরন দেখেই বোঝা যায় যে, এটি একটি ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পরিকল্পনা।
সুধা সদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি দেখিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থা সম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই গতকাল শনিবার শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
তিনি এ হামলার বর্ণনা করে বলেন, গ্রেনেড আক্রমণ ব্যর্থ হলে নেত্রীকে হত্যার বিকল্প পন্থা হিসেবে বন্দুকধারীদের তৈরি রাখা হয়। আর এই বন্দুকধারীরাই খুব হিসাব কষে নেত্রীর গাড়ির কাচে গুলি চালায়। এই গুলি বুলেটপ্রুফ কাচ ভেদ করতে ব্যর্থ হলে তারা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সব শেষে গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় গুলির আঘাতে গাড়ির বাঁ পাশের সামনের ও পেছনের দুটি চাকা পুরোপুরিভাবে পাংচার হয়ে গেলেও চালক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই গাড়িটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউর দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ধানমন্ডির সুধা সদনে নিয়ে আসে।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, গ্রেনেড হামলার পর পরই শেখ হাসিনার নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে ঘেরাও করে নামিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে আসে। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে পর পর অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। এ সময় তাকে ঘেরাও করে রাখা মাহবুব স্পটেই মারা যান। কোনোক্রমে শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পর পরই গাড়ি চালু করতেই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়।

গ্রেনেড হামলা শুরু হলে শেখ হাসিনাকে ঘিরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মানবঢাল। ছবি: জিয়া ইসলাম
গ্রেনেড হামলা শুরু হলে শেখ হাসিনাকে ঘিরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মানবঢাল। ছবি: জিয়া ইসলাম

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর পরই ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সেখানে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। ৬টার দিকে শেখ হাসিনা সুধা সদনে এসে পৌঁছান, এর পরপরই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আসেন যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, মতিয়া চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতৃবৃন্দ।
ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসভবন সুধা সদনের সামনে উপস্থিত দলীয় নেতা-কর্মীদের সর্বক্ষণ উত্সুক প্রশ্ন ছিল-‘নেত্রী কেমন আছেন’? ভবনের ভেতরেই বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আছেন। তবে ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন।

আহত আইভি রহমানসহ কয়েকজন। ছবি: ছবি: জিয়া ইসলাম
আহত আইভি রহমানসহ কয়েকজন। ছবি: ছবি: জিয়া ইসলাম



মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আইভি রহমান
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সামনে গতকাল আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান তার দু পা হারিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পায়ে অস্ত্রোপচারের পর তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে মধ্যরাতে তার পেট ও হূদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার চলছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুও সিএমএইচে চিকিত্সাধীন আছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
এ ছাড়া আমির হোসেন আমু, মোহাম্মদ নাসিম বাঁ পায়ে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মাথা ও পায়ে, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ দু হাঁটুতে, শেখ সেলিম, আবদুর রাজ্জাক, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শেখ বজলুর রহমান, কাজী জাফরুল্লাহ, পংকজ দেবনাথসহ চার শতাধিক নেতা-কর্মী-সমর্থক কমবেশি আহত হন। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব হাসপাতালই ছিল আহতদের ভিড়ে ঠাসা। আহত অবস্থায় প্রথমে প্রায় সবাইকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিভিন্নজনকে সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল: ঘটনার পর থেকে কমবেশি আহত সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একদিকে আহত, অন্যদিকে দলীয় নেতা-কর্মী ও স্বজনদের ভিড়ে পুরো হাসপাতাল এলাকা যেন হয়ে ওঠে হাহাকার ভূমি। তিন শর বেশি আহতকে নিয়ে আসা হয় অ্যাম্বুলেন্স, ট্যাক্সিক্যাব ও সিএনজি বেবিট্যাক্সিযোগে। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে চলে গেছেন রাজধানীর অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উদ্ধার করে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিচ্ছেন ফটোসাংবাদিক মীর মহিউদ্দীন সোহান। দুজনই আজ প্রয়াত। ছবি: জিয়া ইসলাম
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে উদ্ধার করে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিচ্ছেন ফটোসাংবাদিক মীর মহিউদ্দীন সোহান। দুজনই আজ প্রয়াত। ছবি: জিয়া ইসলাম

পঙ্গু হাসপাতাল: পঙ্গু হাসপাতালে গতকাল বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, আহতদের আর্তচিত্কার আর স্বজনদের গগনবিদারী আর্তনাদে প্রকম্পিত সেখানকার পরিবেশ। আতঙ্ক আর অবিশ্বাস নিয়ে এদিক-ওদিক দিগ্ভ্রান্ত মানুষের ছুটোছুটি। আর কিছুক্ষণ পরপর আহতদের দলে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম।
গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫ জনের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। কর্তব্যরত চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে আরো দু-একজনের মৃত্যু হতে পারে। আহতদের মধ্যে ছিলেন সবুজ, আবুবকর, কুসুম পাটোয়ারী, আবদুর রাজ্জাক, সাইদুল, মোঃ হান্নান, সাইফুল, আলাল, অলিউল হক, সবুর, মানিক, সেলিম, শফিকুল, শফিক হোসেন, ইয়াকুব, হানিফ। এখানে গতকাল রাতে ২৫ জনকে ভর্তি করা হয়।
হলি ফ্যামিলি: হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে প্রায় ৫০ জনের মতো চিকিত্সা নিয়েছেন বলে জানা গেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ১৮ জন ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের আঘাত বেশি হলেও আশঙ্কাজনক নয়।
নরসিংদীর সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ হুমায়ুন মাথায় এবং চোয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
হূদরোগ ইনস্টিটিউটে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিত্সা নিচ্ছেন মহিলা আইনজীবী পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ও মোহাম্মদপুর ৪২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহানা বেগম।
শমরিতা হাসপাতাল: শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি আওয়ামী লীগ নেতা সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরুল্লাহ, মসিউর রহমান হুমায়ুন, মমতাজ বেগম ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গানম্যান সেলিম রাতে ইনটেনসিভ কেয়ারে ছিলেন। এ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিত্সারত দেখা যায় আলী আকবর, নীলা চৌধুরী, বিটু বিশ্বাস, লিটন মোল্লা, কাজী মুরশেদ কামাল, সৈয়দ ইয়াছমিনকে।
সাউথ এশিয়ান হাসপাতালে হেদায়েতুল ইসলাম খানকে এবং গ্যাস্ট্রোলিভার হসপিটালে নির্মল গোস্বামী, দেবাশীষ বিশ্বাস, সাগর চিকিত্সাধীন। সেন্ট্রাল হসপিটালে অ্যাডভোকেট উমে, রাজিয়া কাজল ও মেহের বানুকে চিকিত্সাধীন অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া এ হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়ে অন্যত্র যান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবুসহ প্রায় ২০ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী।
মিটফোর্ড হাসপাতাল: এখানে নয়জন চিকিত্সাধীন আছেন। এরা হচ্ছেন সেতারা বেগম, মমিন, শহিদ, বশির আহমেদ, সাগর, বিরাজ তালুকদার, রঞ্জন দাশ, চান মিয়া ও বিল্লাল।

আহতদের আর্তনাদে ভারী হাসপাতালের বাতাস
আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর গতকাল শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালজুড়ে সৃষ্টি হয় এক হূদয়বিদারক দৃশ্যের। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ঘটনাস্থল থেকে অধিকাংশ আহতকে এ হাসপাতালে আনা হয়। নারকীয় এ হামলার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতালটি হয়ে ওঠে লোকারণ্য।
রক্তাক্ত আহতদের যন্ত্রণাকাতর চিত্কার, স্বজনদের আহাজারি আর বুকফাটা আর্তনাদে পুরো হাসপাতাল প্রাঙ্গণের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বোমা হামলার খবর পেয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উত্কণ্ঠিত মানুষ হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বজনদের খবর নিতে।
এদিকে আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত দাঙ্গা পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করলে মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালের আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে দাঙ্গা পুলিশ ও বিডিআর মোতায়েন করা হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নজরদারি অব্যাহত ছিল।
গুরুতর আহতদের ভিড়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আহতদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ওয়ার্ডের বেডগুলো ভরে গেলে মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয় সংকটাপন্ন অনেককে। হাসপাতালের করিডরগুলোতেও পা ফেলার জায়গা ছিল না। সেখানে শুইয়ে রাখা হয় গুরুতর আহত অনেককে। রক্তাক্ত, হাত-পা উড়ে যাওয়া কিংবা স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া হতভাগ্যদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে হাসপাতালের সামনের রাস্তা, সিঁড়ি, করিডর এবং বিভিন্ন ওয়ার্ড।
বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে এ হামলার ঘটনার আধঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কমপক্ষে ৪০০ আহতকে আনা হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এতজনকে চিকিত্সা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় এবং চিকিত্সকের অভাবে অনেককেই মেঝেতে পড়ে থেকে কাতরাতে দেখা যায়। আত্মীয়স্বজনরা অনেককে শহরের অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে স্থানান্তর করেন।
এ হাসপাতালের করিডরে অবহেলায় পড়ে ছিলেন গুরুতর আহত সুফিয়া বেগম (৪৫)। বোমার স্প্লিন্টারের আঘাতে তার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। রক্তাক্ত শরীরে তখনো জীবনের ক্ষীণ চিহ্ন ছিল। রক্তাক্ত এক ফালি কাপড় দিয়ে ঢাকা অচেতন সুফিয়া বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যেন কেউ লাল রঙ দিয়ে সারা মুখ রাঙিয়ে দিয়েছে। তার পাশে বসে বিলাপ করছিলেন আয়শা মোকাররম। একজন চিকিত্সক, নিদেনপক্ষে একজন নার্সের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় তিনি চিত্কার করছিলেন। কিন্তু এ যেন যুদ্ধাবস্থা। কারো সময় নেই কারো দিকে তাকিয়ে দেখার। আহত শত শত মানুষের অবস্থাও একই।
ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ শুয়ে ছিলেন একটি ওয়ার্ডের মেঝেতে। পরনের প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত খোলা। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা এ বৃদ্ধের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বোমার আঘাতে তার পেছনের পুরোটাই ঝলসে গেছে বা উড়ে গেছে। একটু পর পরই গুঙিয়ে উঠছিলেন তিনি। নাম বা পরিচয় বলার মতো অবস্থাও তার নেই। তার পাশে নেই কোনো স্বজন।
আহতদের শরীর থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরছিল। এ জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত রক্তের। হাসপাতালের দোতলার ব্লাড ব্যাংকের সামনে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের লম্বা লাইন সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সেখানে ২৪ ব্যাগ রক্ত গ্রহণ করা হয়। এরপরও অনেকেই তৈরি ছিলেন স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে। কিন্তু রক্ত সংগ্রহের ব্যাগের স্বল্পতা ও মাত্র দুজন নার্সের তত্ত্বাবধানে রক্ত গ্রহণ চলছিল বলে দাতাদের কাছ থেকে ঠিকমতো রক্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আর এ কারণে এক পর্যায়ে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে আসা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

আতঙ্কের নগরী ঢাকা
সন্ধ্যা ৬টা বাজতে ১০। প্রেসক্লাবের সামনে থেকেই দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর ওপর ঝুলে থাকা কালো ধোঁয়ার আকাশ। অল্প কয়েকটি মিনিবাস দুদ্দাড় ছুটে পালাচ্ছে, রাস্তায় সাক্ষী থাকছে কাচের গুঁড়ো। দুই ট্রাক পুলিশ হাইকোর্টের সামনে থেকেই রাস্তায়। বুটের শব্দে দশদিক সচকিত করে যাচ্ছেন অকুস্থলে। দু পাশের রাস্তায় হাজার খানেক নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু দাঁড়িয়ে আছে বিহ্বল হয়ে। আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই পুরো ঢাকা আতঙ্কের নগরী।
সচিবালয়ের দুই দরজায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন সারা দিনের ক্লান্ত কর্মচারী-কর্মকর্তারা। এ সময়েই আরো তিনটি চাপা বিস্ফোরণের শব্দ। অসহায় মানুষ রাস্তার দু পাশে জায়গা বদল করে। সচিবালয়ের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকা শহরে আর থাকব না। যাবই বা কোথায়। কোথায় গেলে নিশ্চিতভাবে নিরাপদ জীবন মিলবে। বিড়বিড় আর ফিসফিস।
আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট রহমত আলী সচিবালয়ের সামনে রক্তমাখা পাঞ্জাবি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন দলীয় এক সমর্থকের কাঁধে মাথা রেখে। প্রথম বোমাটি বিস্ফোরণের পরেই আর কিছু তার মনে নেই। আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে তখন জ্বলছে মোটরগাড়ি আর বাস। আহত সাংসদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার মতো অবস্থা নেই কারো।

বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে আগুন দেয়। ছবি: জিয়া ইসলাম
বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে আগুন দেয়। ছবি: জিয়া ইসলাম

বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স-অ্যানেক্স ভবনের সামনে প্রাণচঞ্চল শিক্ষার্থীরা যেন পাথরের মূর্তি। হাসপাতালের সামনে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই। কতজন হতাহত? বলা অসম্ভব। শুধু জানা যাচ্ছে, ওয়ার্ডের সামনের করিডরেও এখন মারাত্মক আহত রোগীদের শুইয়ে দেওয়ার জায়গা নেই।
ঢাকা মেডিকেল থেকে পিজি হাসপাতাল হয়ে শমরিতা, বাংলাদেশ মেডিকেল, হলিফ্যামিলি, সাউথ এশিয়া-আহতদের জন্য যথেষ্ট নয় এতগুলো হাসপাতাল। রক্তে মাখামাখি আহতদের অধিকাংশই চিকিত্সার আশা বৃথা বুঝতে পেরে একটু উপশমের আশায় বসে পড়েছেন রাস্তায়। মৃত্যুর এক মুহূর্ত দূরে থাকা এসব নারী-পুরুষকে ঘিরে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় ছোট-বড় জটলা।
অনেক রুটেই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। আতঙ্কিত স্বজনদের উত্কণ্ঠা আরো বাড়াতে মোবাইল নেটওয়ার্কগুলো কাজ করছে না ঠিকমতো। এর মধ্যেই নাগরিকরা ঘরে ফেরার উপায় খুঁজছেন। সকলের অবয়ব আর অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠেছে পরাজয়। মানুষের এই পরাজয়ের অনুভূতিগুলো বড়ই অসম্মানের। আতঙ্কের জুজু এখন দানব আর ঘরের দরজায় চলে আসা নিত্যদিনের বাস্তবতা।

ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে কেঁদে ফেললেন শেখ হাসিনা
‘আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতা-কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনো আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।’ এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সমাবেশে গ্রেনেড হামলার কিছুক্ষণ পর বিবিসিকে টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাত্কারে শেখ হাসিনা এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারের মদদে সারা দেশেই তো বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে। আমাদের এ মিছিলটাই ছিল বোমা হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এ জন্যই তারা জবাব দিল গ্রেনেড মেরে। আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে উঠব ঠিক তখনই ওই জায়গাটাই হামলাকারীরা টার্গেট করেছিল। পরপর ৮-১০টা গ্রেনেড ফাটে। এখনো ওখানে দু-তিনটা অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পড়ে আছে। আমাদের মহিলাকর্মীসহ অনেকে নিহত হয়েছেন। প্রেসিডিয়ামের প্রায় সব সদস্য আহত হয়েছেন। আইভি রহমানের অবস্থা খুবই খারাপ।’
এ হামলার পর বিক্ষোভ শান্ত করার জন্য কী ভাবছেন-এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এতগুলো মানুষ মারা গেছে। মানুষের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? একটার পর একটা বোমা হামলার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মানুষ তো বিক্ষুব্ধ হবেই।’
আওয়ামী লীগের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতারা বসেছেন। তারা আলাপ-আলোচনা করছেন। এখন যারা মারা গেছে তাদের জানাজা, প্রতিবাদসভা, বিক্ষোভ ছাড়াও কী ধরনের কর্মসূচি হবে তা ঠিক করা হবে।’
শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী যখন হতাহতদের উদ্ধার করছিল ঠিক সে সময় পুলিশ উল্টো লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।
সরকারের মদদে এ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে শেখ হাসিনা দাবি করেন। তিনি বলেন, পুলিশ আহতদের সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে যেভাবে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করল ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল তাতে তো বোঝা যায়, এটা সম্পূর্ণ সরকারের মদদে করা হয়েছে। কাজেই এ অবস্থায় আমি মনে করি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। তারা একটার পর একটা এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে এটা কখনো সহ্য করা যায় না।