আত্মসমর্পণেও থামেনি অপহরণ

>
  • গত দুই বছরে ২৬টি দস্যু বাহিনীর বাহিনীপ্রধানসহ ২৭৪ জন আত্মসমর্পণ করেছেন।
  • ৫০ জেলেকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণের তথ্য পাওয়া গেছে।
  • ৬০ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পেয়ে গত দুই বছরে সুন্দরবনের ২৬টি দস্যু বাহিনীর বাহিনীপ্রধানসহ ২৭৪ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয় বছরে নিহত হয়েছে শতাধিক দস্যু, গ্রেপ্তার হয়েছে পাঁচ শতাধিক। তারপরও সুন্দরবনে থেমে নেই দস্যুতা। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাহিনী। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সুন্দরবন। গত তিন মাসে এই এলাকায় অন্তত ৫০ জেলেকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণের তথ্য পাওয়া গেছে।

সুন্দরবন উপকূলের জেলে, মহাজন ও বনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, আড়ালে থেকে যাঁরা দস্যুদের মদদ ও অস্ত্র সরবরাহ করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় না আনা গেলে উপকূলে দস্যুবৃত্তি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার যে সুযোগ দিচ্ছে, তার সুযোগও নিচ্ছে কেউ কেউ। দস্যুরা ধারণা করছে, দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে আত্মসমর্পণ করলেই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে। তা ছাড়া পুনর্বাসনের জন্য টাকাও পাওয়া যাবে। ফলে কেউ কেউ সহজেই জড়িয়ে যাচ্ছে দস্যুতায়।

বন বিভাগ ও বনজীবী সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন মৌসুম সামনে রেখেই দস্যুরা সুন্দরবন ও সংলগ্ন সাগর উপকূলে জড়ো হয়ে ডাকাতি ও অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের প্রস্তুতি নেয়। সুন্দরবন-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুঁটকি মৌসুম, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইলিশ, মধু ও মোম মৌসুম এবং বছরের অন্য সময় গোলপাতা আহরণ মৌসুম থাকায় প্রায় বছরজুড়েই দস্যুদের অপতৎপরতা থাকে।

জেলে ও বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, অপহরণ, ডাকাতি, জেলেদের হাত-পা বেঁধে সাগরে নিক্ষেপ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুক্তিপণ না পেলে নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করছে দস্যুরা। চলতি ইলিশ মৌসুমের গত তিন মাসে সুন্দরবন ও সাগর উপকূলে মুক্তিপণের দাবিতে ৫০ থেকে ৬০ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও একাধিক জেলে নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জেলে ও মহাজনেরা কোনো অভিযোগ না করেই মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেন। যত ঘটনা ঘটে তার অল্প কিছু প্রকাশিত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১২ মে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের মালঞ্চ নদ থেকে ১৩ জেলেকে কাজল বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৪ মে)। ৯ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া, মরাপশুর ও ঝাপসি এলাকা থেকে শরিফ বাহিনীর পরিচয়ে ৮ জেলেকে অপহরণ করা হয়। (বাংলা ট্রিবিউন, ১০ জুলাই)। ১০ জুলাই পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের দায়ের গাং এলাকা থেকে ছোট ভাই ওরফে জাকির বাহিনী পরিচয়ে ২ জেলেকে অপহরণ করা হয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুলাই)। ২৪ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের শ্যালার চর টহল ফাঁড়ির সামনে থেকে ছোট ভাই ওরফে জাকির বাহিনীর পরিচয়ে ৮ জেলেকে অপহরণ করা হয়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ জুলাই)। সর্বশেষ গত ২৮ জুলাই সুন্দরবনের দুবলার চর এলাকা থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলারসহ ১৫ জেলেকে ছোট ভাই ওরফে জাকির বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়। (প্রথম আলো, ২৯ জুলাই)। মুক্তিপণ দিয়েই অপহৃত জেলেদের ছাড়িয়ে আনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বন বিভাগ ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় পূর্ব সুন্দরবনের দুটি ও পশ্চিম সুন্দরবনের দুটি রেঞ্জে ২৫ থেকে ৩০টি দস্যু বাহিনী সক্রিয় ছিল। র‍্যাব-৮ ও র‍্যাব-৬ গত দুই বছরে এসব দস্যু বাহিনীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়। ফলে দুই বছরে ২৬টি দস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ২৭৪ জন দস্যু, ৪০৪টি অস্ত্র, প্রায় ২০ হাজার গুলিসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সূত্র আরও জানায়, গত ৬ বছরে উপকূলজুড়ে র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে শতাধিক দস্যু। এই সময়ে র‍্যাবের বিভিন্ন অভিযানে ১ হাজার ৫৪২টি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৭২ জন দস্যু।

এরপরও সুন্দরবন ও সাগর উপকূলে এখনো ৫-৬টি বাহিনী সক্রিয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাকির ওরফে ছোট ভাই বাহিনী, সাত্তার বাহিনী ও শরিফ বাহিনী। জাকিরের দলে ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। পশুর নদের পশ্চিমে বিশেষ করে সুন্দরবনের ভদ্রা এলাকার নিচে এদের অবস্থান। এই তিনটি বাহিনীর সঙ্গে আরও দু-একটি দস্যু বাহিনী এখনো সুন্দরবন ও সাগর উপকূলে জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে চলেছে। সব কটি বাহিনীই নতুন। সম্প্রতি গড়ে উঠেছে।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি শরণখোলা শাখার সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘অনেকগুলো দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণের পর জেলেদের অপহরণ কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। কিছু কিছু দস্যু বাহিনীর কথা আমরা শুনছি। কিছু অপহরণের ঘটনাও ঘটছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে র‍্যাব-৮ দস্যু দমনে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।’

নেপথ্যে থেকে দস্যুদের আত্মসমর্পণে কাজ করে চলেছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন উল হাকিম। তিনি বলেন, দস্যুদের যাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা করেন, অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করেন, বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন, তাঁদের যেকোনো মূল্যে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে নিজেদের স্বার্থে তাঁরা নতুন নতুন দস্যু বাহিনী তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন, র‍্যাব ও কোস্টগার্ড যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে দস্যু দমনে আরও কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।

র‍্যাব-৮-এর উপ-অধিনায়ক মেজর খান সজিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা আত্মসমর্পণের সুযোগ গ্রহণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইছে, তাদের সে সুযোগ দিচ্ছি। আর যারা দস্যুতা থেকে বের হচ্ছে না তাদের আইনের আওতায় আনছি। আশা করছি খুব দ্রুত সুন্দরবন ও উপকূল দস্যুমুক্ত করতে সমর্থ হব।’ মদদদাতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, দস্যুদের যাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন, অস্ত্র সরবরাহ করছেন, তাঁদের দ্রুত আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আনা হবে।