চট্টগ্রামে দিনে ১৪টি সংসার ভাঙছে

>
  • সবচেয়ে বেশি আবেদন ২০১৪ সালে, ৫ হাজার ৯৮৫টি
  • ২০১৫ সালে আবেদন কিছুটা কমে হয় ৪ হাজার ৪৭৮টি
  • ২০১৬ সালে আবেদন বেড়ে হয় ৪ হাজার ৯৪৯টি
  • প্রতিবছর আবেদনকারীর সংখ্যা বাড়ছে
  • পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হওয়া এর কারণ

পারিবারিকভাবে ২০১৪ সালের এপ্রিলে বিয়ে করেন মেহেরুন নেসা (ছদ্মনাম)। কয়েক মাস না যেতেই তাঁর ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন স্বামী। ভেবেছিলেন সন্তান হওয়ার পর নির্যাতন কমবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক এনে দিতে তাঁর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নীরবে সব সহ্য করছিলেন তিনি। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকায় বাধ্য হয়ে বাবা-মায়ের সম্মতি নিয়ে গত বছরের ২১ জুলাই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন তিনি।

এই তরুণীর মতো গত বছর চট্টগ্রাম শহরে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে আবেদন করেন ৪ হাজার ৯৭০ জন। অর্থাৎ, দিনে গড়ে ১৪টি সংসার ভাঙছে। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ২ হাজার ৫৩২টি। আবেদন করার পর সমঝোতার মাধ্যমে সংসার টিকে যায়, এমন উদাহরণ খুব কম। আবেদনকারীদের অধিকাংশই নারী।

উচ্চবিত্ত হোক আর নিম্নবিত্ত হোক, বিবাহবিচ্ছেদের সব আবেদনের ভাষা প্রায় এক। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে জমা দেওয়া বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মেয়েদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের বনিবনা না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি। আর ছেলেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা, স্বামীর কথা না শোনা।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে ২০১৪ সালে, ৫ হাজার ৯৮৫টি। পরের বছর ২০১৫ সালে তা কিছুটা কমে হয় ৪ হাজার ৪৭৮টি। ২০১৬ সালে এ রকম আবেদনের সংখ্যা আবার বেড়ে হয় ৪ হাজার ৯৪৯। এ ছাড়া ২০১৩ সালে আবেদনকারীর সংখ্যা ৩ হাজার ৪৫৪।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১০ সাল থেকে এ ধরনের আবেদনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা নেই। তবে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দিন দিন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ এফ ইমাম আলি ও ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু। তাঁরা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে। যুক্তির চেয়ে তাৎক্ষণিক আবেগের কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকে। তা ছাড়া নারীরা আগের চেয়ে শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সংসারে ভূমিকা ও অধিকারের স্বীকৃতি চান তাঁরা। কিন্তু অনেক পরিবারেই স্ত্রীদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা দিতে চান না স্বামীরা। তখনই দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়। এরই পরিণতি বিচ্ছেদ। এই প্রবণতা আরও বাড়বে বলে তাঁদের আশঙ্কা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুটি সালিসি আদালতের মধ্যে আদালত ২-এ বিচ্ছেদের আবেদন তুলনামূলক বেশি। গত বছরের ৪ হাজার ৯৭০টি আবেদনের মধ্যে ৩ হাজার ৫৭টিই জমা পড়েছিল এই আদালতে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত জমা পড়েছে ১ হাজার ৫৬০টি।

ইপিজেড থানায় চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এবং কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের অবস্থান। ইপিজেড থানায় পোশাক কারখানা, জুতার কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২০০ কারখানা রয়েছে। এসব এলাকা থেকে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন বেশি জমা পড়ে। এসব এলাকায় পোশাকশ্রমিকেরা বেশি থাকেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, বিচ্ছেদের আবেদনকারীদের বেশির ভাগই নারী। আবার তাঁদের মধ্যে পোশাকশ্রমিকের সংখ্যা বেশি। তাঁরা যে টাকা আয় করেন, সেটি পাওয়ার জন্য স্বামীরা অত্যাচার করেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া এসব নারী বাধ্য হয়ে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেন। তিনি বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন পাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকেই শুনানিতে ডাকেন তাঁরা। এলে এই পথ বেছে না নিতে নানাভাবে কাউন্সেলিং (পরামর্শ) করেন তাঁরা। কিন্তু বিচ্ছেদ চেয়ে আবেদন করার সমঝোতার মাধ্যমে সংসার টিকিয়ে রাখার ঘটনা খুব কম। প্রতি ১ হাজারে সর্বোচ্চ ৫০টি ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে এসেছিলেন এক তরুণী। বিয়ের সাড়ে ছয় বছর পর সম্প্রতি স্বামীকে তালাক দেওয়ার আবেদন করেন তিনি। এই তরুণী বলেন, কয়েক বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। এ ছাড়া স্বামী মাদকাসক্ত। শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁকে নির্যাতন করা হচ্ছিল। এভাবে সংসার করা সম্ভব নয় বলে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

তালাক চেয়ে আবেদন করা পোশাকশ্রমিক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ২০০৫ সালের মার্চে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয়। ২০০৯ সালে কন্যাসন্তানের বাবা হন তিনি। আরেকটি বাচ্চা নেওয়াকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে সংসারে অশান্তি শুরু হয়। তাঁর স্ত্রী সন্তান নিতে রাজি নন। একপর্যায়ে মেয়েকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান স্ত্রী। তাঁর দাবি, অনেক চেষ্টা করেও স্ত্রীকে ঘরে ফিরিয়ে আনা যায়নি। পরে তিনি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

বিবাহবিচ্ছেদে ইচ্ছুক স্বামী বা স্ত্রীকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা লিখিতভাবে (তালাক নোটিশ) প্রথমে সিটি করপোরেশনের মেয়রকে জানাতে হয়। যাঁকে তালাক দিতে ইচ্ছুক তাঁকেও সেই নোটিশ পাঠাতে হয়। কারও কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর মেয়র নোটিশটি সালিসি আদালতে পাঠিয়ে দেন। এই আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। আদালত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেন। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা চালান আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: