যৌতুকের মামলা হয়ে গেল ধর্ষণের

>কক্সবাজারে যৌতুকের মামলার আসামির নাম ও অপরাধের ধরন পাল্টে চট্টগ্রাম নগরের এক দরজির বিরুদ্ধে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।

যৌতুক চাওয়ায় স্বামীর বিরুদ্ধে কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি করেছিলেন স্ত্রী। এই মামলাটি ওই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। কিন্তু একই মামলায় আসামির নাম ও অপরাধের ধরন পাল্টে দিয়ে চট্টগ্রাম নগরের এক দরজির বিরুদ্ধে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জরি করা হয়। একটি জালিয়াত চক্র সূক্ষ্মভাবে কাজটি করে বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে ভুয়া পরোয়ানায় ১ আগস্ট গ্রেপ্তার হন দরজি মো. ফোরকান। তিনি এখন চট্টগ্রাম কারাগারে।

ভুক্তভোগীর পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদালতের একটি জালিয়াত চক্র ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরি করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের মাধ্যমে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানায় পাঠায়। এই চক্রের সঙ্গে ভুক্তভোগী ব্যক্তির প্রতিবেশী পরিবার ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ প্রশাসন পুরো বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ভুয়া পরোয়ানার ভিত্তিতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার পুলিশ মো. ফোরকানকে ১ আগস্ট দুপুর ১২টায় নগরের আতুরার ডিপো এলাকার জজ টেইলার্স নামের দোকান থেকে গ্রেপ্তার করে। আতুরার ডিপো এলাকায় ফোরকানের বাড়ি। চার ভাইয়ের মধ্যে ফোরকান তৃতীয়। বড় ভাই মোটর মেকানিক। দ্বিতীয় ভাই মসজিদের মুয়াজ্জিন ও চতুর্থ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ভুয়া পরোয়ানার ভিত্তিতে ফোরকান গ্রেপ্তার হন। একটি জালিয়াত চক্র কক্সবাজার আদালতের একটি মামলার রেফারেন্স ব্যবহার করে এই পরোয়ানা তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের মাধ্যমে তা থানায় গেছে। ভুয়া পরোয়ানা কারা তৈরি করেছে, তা তদন্ত করে বের করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে রশিদা বেগম নামের এক নারী তাঁর স্বামী হুমায়ুন, শাশুড়ি ফাতেমা বেগম ও শ্বশুর আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে যৌতুক আইনে মামলা করেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। মামলা নম্বর ২৩৫/১৬ ও দায়রা নম্বর ৮৯২/১৮। মামলাটি ওই ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। কিন্তু এই মামলায় মো. ফোরকানকে আসামি দেখিয়ে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরোয়ানায় ফোরকানের বিরুদ্ধে যুক্ত করা হয় ধর্ষণ ও অপহরণের ধারা।

১ আগস্ট বায়েজিদ থানা পুলিশ ফোরকানকে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে ছিলেন। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে ফোরকানের বড় ভাই মো. সেলিম আইনজীবীর শরণাপন্ন হন। ওই দিন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর কক্সবাজারের আদালতে যোগাযোগ শুরু করেন ফোরকানের আইনজীবী। ফোরকান সংশ্লিষ্ট মামলার আসামি কি না, তা আদালতের নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে কক্সবাজারের আদালতে জমা দেন আইনজীবী। এরপর ১৯ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এ-সংক্রান্ত একটি জবাব দেন। তাতে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট নথি ও রেজিস্টার পর্যালোচনায় উল্লেখিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলায় উল্লেখিত (ফোরকান) আসামি নাই মর্মে দৃষ্ট হয়।’

ফোরকানের আইনজীবী মো. হারুন-আল-রশিদ এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে এক নারী তাঁর স্বামী, শাশুড়ি ও শ্বশুরের বিরুদ্ধে যৌতুক আইনে মামলা করেন। কিন্তু সেই মামলার অপরাধের ধরন পাল্টে দিয়ে ফোরকানের বিরুদ্ধে ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বানায় একটি জালিয়াত চক্র। এই চক্রের সঙ্গে ফোরকানের প্রতিবেশী একটি পরিবার ও একজন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন। পুরো বিষয়টির তদন্ত হওয়া জরুরি।

এই আইনজীবী আরও বলেন, কক্সবাজার আদালত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ফোরকান ওই মামলার আসামি নন। আর কক্সবাজারের কোতোয়ালি থানায় ফোরকানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা আছে বলে ভুয়া পরোয়ানায় উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় ‘কোতোয়ালি থানা’ বলতে কোনো থানার অস্তিত্ব নেই।

ফোরকানের বড় ভাই মো. সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আতুরার ডিপো এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে জায়গা নিয়ে বিরোধের কারণে একটি দেওয়ানি মামলা আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু ওই প্রতিবেশী পরিবার আমাদের ঘায়েল করতে নানা ষড়যন্ত্র করছে।’

সেলিম আরও বলেন, ‘ভুয়া পরোয়ানায় আমার ভাই গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী পরিবারের একজন সদস্য দ্রুত আদালতে চলে যান। সেখানে তাঁকে দেখেছি। ওই পরিবারের সঙ্গে একজন পুলিশ কর্মকর্তার সখ্য আছে। ওই পরিবারের কর্মকাণ্ডে এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ জোরালো হয়েছে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বায়েজিদ থানার উপপুলিশ পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আদালত হয়ে একটি পরোয়ানা থানায় আসে। কর্তৃপক্ষের আদেশে পরোয়ানা তামিল করি। কিন্তু ওই পরোয়ানা ভুয়া ছিল বলে পরে জানতে পেরেছি। এটা দুঃখজনক।’