তিনি এখন কৃষি বায়োস্কোপওয়ালা

ধানের শেষ মুহূর্তের পরিচর্যার বিষয়ে চাষিদের হাতে–কলমে শেখাচ্ছেন তালহা জুবাইর মাশরুর (ধানের শিষ হাতে)। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীনগরে।  ছবি: প্রথম আলো
ধানের শেষ মুহূর্তের পরিচর্যার বিষয়ে চাষিদের হাতে–কলমে শেখাচ্ছেন তালহা জুবাইর মাশরুর (ধানের শিষ হাতে)। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবীনগরে। ছবি: প্রথম আলো

তাঁর নাম তালহা জুবাইর মাশরুর। তবে এখন তিনি কারও কারও কাছে ‘কৃষি বায়োস্কোপওয়ালা’ নামে পরিচিত। তালহা বিষয়টি উপভোগই করেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (২৯তম বিসিএস) তালহা জুবাই মাশরুর। কৃষির উন্নয়নে তথ্যচিত্র ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ তৈরি করে দেশ-বিদেশে লাখো মানুষের নজর কেড়েছেন তিনি। শহুরে শৌখিন কৃষক থেকে গ্রামের খেতখামারে খেটে খাওয়া ভূমিহীনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় কৃষি তথ্য। স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে পেয়েছেন সরকারের উদ্ভাবনী বিভাগে শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তার পুরস্কার।

তালহা জুবাইর এ পর্যন্ত ৯২টি তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) তৈরি করেছেন। এসব তথ্যচিত্রের মডেল একেকজন সফল কৃষক। তথ্যচিত্রগুলো গ্রামে গ্রামে বড় পর্দায় (প্রজেক্টর) প্রদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় কেব্‌ল টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবেও চলছে প্রচার। শুধু শজনে পাতার চাষ ও গুণাগুণ নিয়ে তাঁর তৈরি তথ্যচিত্রটি ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখেছেন ৬২ লাখের বেশি দর্শক।

তালহার এই উদ্যোগের সঙ্গে কৃষক, সরকারি-বেসরকারি কৃষি কর্মীসহ উপকারভোগীদের যুক্ততা দিন দিন বাড়ছে। স্মার্টফোনের কল্যাণে ঘরে বসেই সবাই পেয়ে যাচ্ছেন প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত।

একটা সময় গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল বায়োস্কোপ। সাধারণত তথ্য অফিস থেকে সিনেমাভ্যান নিয়ে গ্রামে গ্রামে সরকারের উন্নয়ন চিত্রের পাশাপাশি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বড় পর্দায় প্রজেক্টর দিয়ে দেখানো হতো। আবার টিনের বাক্সে তৈরি টুনি বায়োস্কোপও ছিল বিনোদনের মাধ্যম।

চুয়াডাঙ্গায় সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর উপপরিচালকের কার্যালয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে এক প্রশিক্ষণে প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষি প্রযুক্তিবিষয়ক বেশ কিছু তথ্যচিত্র দেখাচ্ছিলেন তালহা জুবাইর। প্রদর্শিত তথ্যচিত্রের বেশ কয়েকটি ছিল তাঁর নিজের তৈরি। প্রশিক্ষণ শেষে গাড়াবাড়িয়ার কৃষক আবদুল লতিফ এই কৃষি কর্মকর্তাকে বললেন, এই প্রশিক্ষণে মাত্র ৩০ জন কৃষক উপকৃত হলেন। কিন্তু গ্রামে গ্রামে এই বায়োস্কোপ দেখালে অনেক কৃষকের উপকার হবে। জুবাইর বলেন, ‘কৃষক আবদুল লতিফের ওই কথা থেকেই কৃষি বায়োস্কোপের আইডিয়া (ভাবনা) মাথায় আসে।’

২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুলটিয়া গ্রামে প্রজেক্টর দিয়ে ‘কৃষি বায়োস্কোপ’-এর প্রথম প্রদর্শনী হয়। এদিন বোরো ধান লাগানোর সঠিক পদ্ধতি বিষয়ে সচিত্র ধারণা দেওয়া হয়। তথ্যচিত্রে এলাকার কয়েকজন কৃষককে মডেল হিসেবে দেখানো হয়। ভিডিও চিত্রে পরিচিতজনের মুখ থেকে অতি প্রয়োজনীয় কথা শুনে কৃষকেরা সহজে অনুপ্রাণিত হন।

কৃষিবিদ তালহা বলেন, ‘কৃষিবিষয়ক কনটেন্টের স্বল্পতার কারণে আমি নিজেই সময় উপযোগী কনটেন্ট তৈরি করা শুরু করি। ভিডিও চিত্র ধারণসহ কনটেন্ট তৈরির কাজে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নানাভাবে আমাকে সহযোগিতা করছেন।’ তিনি আরও বলেন, কোনো গ্রামে বায়োস্কোপ প্রদর্শনের কর্মসূচি নিলে তার আগে ওই গ্রাম বা আশপাশের সফল কৃষকদের নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। কৃষিকাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে কৃষি বিভাগের কর্মীদের মাঠপর্যায়ের সমন্বয় ঘটানো হয় তথ্যচিত্রে। এসব তথ্যচিত্র প্রদর্শনের সময় নিজের বা পরিচিত ব্যক্তিদের ভিডিও দেখতে গ্রামে গ্রামে ভিড় জমে যায়। এই প্রক্রিয়ায় অল্প সময়ে অধিকসংখ্যক কৃষকের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

তালহা জুবাইর বলেন, তথ্যচিত্রগুলো চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং দেশের বাইরেও ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই মুঠোফোনে ধারণ করা। কৃষকেরা এখন তাঁদের স্মার্টফোনে ইউটিউব অথবা ফেসবুকে ঢুকে ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ দেখে মৌসুমভিত্তিক সবজি ও ফসলের চাষাবাদ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা-অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন এবং কৃষি উন্নয়নে তা কাজে লাগাচ্ছেন। প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আধুনিক চাষাবাদ শুরু করছেন অনেকে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দীননাথপুরের হারিছ উদ্দিন ভিয়েতনামের খাটো নারকেল, ঝোপপদ্ধতি ও থাই পেয়ারা; হানুরবারাদীর দোয়াল্লিন হোসেন অসময়ের তরমুজ; হবিগঞ্জের চয়ন মিয়া ১০ বিঘা ও ঝিনাইদহের নাজমুল ইসলাম এক বিঘা জমিতে বাউল লাউ এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মুজিব হোসেন পাঁচ বিঘা জমিতে অসময়ের তরমুজ চাষ করে সফল হয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে ভোলার রায়হান উদ্দিন, দিনাজপুরের সাইফুল ইসলাম, কক্সবাজার চকরিয়ার মাহবুব আলম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের সোহেল আখতারসহ অনেকেই সমন্বিত কৃষি খামার গড়েছেন। তাঁদের সবার প্রেরণা কৃষি বায়োস্কোপ।

কৃষি কর্মকর্তা তালহার তৈরি ৯২টি তথ্যচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ দেখেছে অলৌকিক গাছ সজিনা পাতার বিস্ময়কর গুণ তথ্যচিত্রটি। গতকাল পর্যন্ত ফেসবুকে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ভিডিওটি দেখেছে। শেয়ার করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। আর ইউটিউবে দেখেছে ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৪১০ জন। একই সময় পর্যন্ত ইউটিউবে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দী একসঙ্গে—কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার—আজব মেশিন তথ্যচিত্রটি দেখেছে সাড়ে ৯ লাখ মানুষ। এ ছাড়া বেড তৈরি, বীজ বপন সবই হবে একসঙ্গে—বেড প্লান্টার: আজব মেশিন, অর্থ ও সময় দুটোই হবে সাশ্রয় তথ্যচিত্রটি তিন লাখ ২৮ হাজার মানুষ দেখেছে। ঘৃতকুমারীর ঔষধি গুণ, ব্যবহার, চাষপদ্ধতি, খরচ ও লাভের হিসাব দেখেছে আড়াই লাখ লোক। ড্রাগন ফলের শৌখিন চাষ দেখেছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৮ জন। মৌমাছি পালন ও মধু চাষ, অর্থ-স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বারো মাস দেখেছে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৫ জন। স্কোয়াশ চাষবিষয়ক প্রতিবেদন দেখেছে ১ লাখ ৭১ হাজার ২৩৯ জন। শস্য বিন্যাস: বেবী তরমুজ, লাউ ও আলু দেখেছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ।

অলৌকিক গাছ সজিনা পাতার বিস্ময়কর গুণ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ডাঁটার পাশাপাশি পুষ্টির অনন্য উৎস শজনে পাতা। একটা ডাল পুঁতলে যে গাছ হয়ে যায়, তার বিস্ময়কর গুণ হচ্ছে, লেবু থেকে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি আছে শজনে পাতায়। দুধের থেকে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম এবং ডিম থেকে দুই গুণ বেশি প্রোটিন আছে এতে। রয়েছে গাজর থেকে চার গুণ ভিটামিন এ। শজনে পাতা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে। কলা থেকে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম রয়েছে। এটা হৃদ্‌যন্ত্র ভালো রাখে, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। কোলেস্টেরল ও কোষ্ঠ্যকাটিন্য কমায়। অ্যাজমা রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী।

এভাবে প্রতিটি তথ্যচিত্রে সবজি, ফল ও ফসলের চাষপদ্ধতি, খরচ ও লাভের হিসাব, বাজার ব্যবস্থাপনা ও গুণাগুণ জানানো হয়। এতে উৎপাদনকারীর পাশাপাশি ভোক্তারাও উপকৃত হচ্ছেন।

তালহা জুবাইরের সহকর্মী উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল রাসেল বলেন, কৃষি বায়োস্কোপ কৃষকদের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এবং স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে তাঁদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসীনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে গত ২৪ জুলাই ফেসবুক লাইভে তিনি কৃষি বায়োস্কোপ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা কৃষি প্রযুক্তিগুলো কৃষকের কাছে সরাসরি পৌঁছাতে চাই। এই ছোট ছোট ভিডিও থেকে কৃষকেরা অত্যন্ত কার্যকভাবে কৃষি বিষয়ে জানতে ও শিখতে পারছেন।’