গরিবের ভিটায় বিদ্যুৎকেন্দ্র

>
  • বরগুনার তালতলীর ছোট নিশানবাড়িয়ার অংকুজান গ্রাম
  • গ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি হারানোর আশঙ্কায় আছে
  • সেখানে ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে
  • প্রকল্প থেকে শ্বাসমূলীয় সংরক্ষিত বন টেংরাগিরির দূরত্ব চার কিলোমিটারের কম
  • আইন অমান্য করে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে আইসোটেক

সাংবাদিক এসেছে শুনে বহু দূরের পথ একপ্রকার দৌড়ে এসেছেন বৃদ্ধা। কাছে এসে আর কথা বলতে পারলেন না, পড়ে গেলেন মাটিতে। কোনোমতে বললেন, ‘আমি কোথায় থাকব? কীভাবে বাঁচব?’ এই আর্তি বরগুনার তালতলীর ছোট নিশানবাড়িয়ার অংকুজান গ্রামের ভূমিহীন খবিরুন্নেসার।

এই বৃদ্ধার মতো অংকুজান গ্রামের ৪৫০ পরিবারের কয়েক হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কায় দিন পার করছেন। ওই গ্রামের ভূমিহীনদের ৩১০ একর জমির ওপর আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি’র ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পায়রা নদীর মোহনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সাইনবোর্ড। খোট্টার চর হিসেবে পরিচিত এ এলাকায় বসবাসরত সবাই সাগর ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সীমানা লাগোয়া বন বিভাগের সৃজিত বনভূমি রয়েছে।

এ প্রকল্প থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় সংরক্ষিত বন টেংরাগিরির দূরত্ব চার কিলোমিটারের কম। আর নদীর ওপারে বরগুনার পাথরঘাটার সংরক্ষিত লালদিয়া বনের দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম।

জানা গেছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের চূড়ান্ত অনুমতি বা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) নেয়নি আইসোটেক। পরিবেশের জন্য লাল ক্যাটাগরির অতিবিপজ্জনক তালিকায় থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করতে হলে ইআইএর অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। আইসোটেক এসব আইন অমান্য করে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে।

এলাকাবাসী জানায়, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে পায়রা নদী থেকে খোট্টারচর জেগে ওঠার পর সেখানে স্থানীয় ভূমিহীন দরিদ্র মানুষ বাস শুরু করে। এরপর বরগুনার জেলা প্রশাসক ২০০২ সালে ৯৯ বছরের জন্য পরিবারপ্রতি এক একর জমি ইজারা দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী এ জমি কেউ বিক্রি করতে পারবে না।

জানতে চাইলে বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এটি পায়রা নদীর তীরে জেগে ওঠা নদীর জমি। নদীর জায়গা মূলত সরকারের। সরকারি জমি বিভিন্ন সময় অধিগ্রহণ করে বিভিন্ন প্রকল্পে দেওয়া হয়। তবে সে ক্ষেত্রে আইন মেনে আবেদন করতে হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র কোম্পানির কাছ থেকে এ ধরনের কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া গত ২৯ মে হাইকোর্ট অংকুজান গ্রামে সরকারি খাসজমিতে ৩০৭ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের স্থগিতাদেশ দেন। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৪টি মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা ভরাট করা হচ্ছে।

নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাঁদের বলেছিলাম আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে, মাটি কাটা বন্ধ রাখুন। তাঁরা সেটি না শুনেই মাটি ফেলার কাজ করছে। এ জায়গাটি বহুদিন ধরে ভূমিহীনরা সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ভোগদখল করছে, সেটি বেসরকারি কোম্পানি কী করে দখল করে নিয়ে যায়?’

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইসোটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনেছি। সেখানে সরকারি জমি আগে ছিল। তবে সম্প্রতি আদালত থেকে রায় পেয়েছে কিছু ব্যক্তি। আমি তাদের কাছ থেকে জমি কিনেছি। যদি জমি নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকে, তাহলে সেটি আমরা নিষ্পত্তি করব। প্রকল্প এলাকায় যাদের বাড়িঘর আছে, প্রত্যেককে আমরা নতুন পাকা বাড়িঘর বানিয়ে দেব।’ তবে তিনি আদালতের কোনো রায় দেখাতে পারেননি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আমি হাতে পাইনি। এটা খতিয়ে দেখব।’

প্রতিবাদ করায় চাঁদাবাজির মামলা
সরেজমিনে দেখা গেছে, পায়রা নদীর মোহনায় বাস করা অধিকাংশ লোকই হতদরিদ্র। সরকারের কাছ থেকে নেওয়া খাসজমিই তাঁদের একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই। বিদ্যুৎ কোম্পানি এই জমি কেড়ে নেওয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ করেন। আর এ জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে প্রকল্পের প্রকৌশলী মো. মুরাদ বাদী হয়ে গত ১৮ জুলাই ছয়জনকে আসামি করে ৩০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির মামলা করেন।

গ্রামবাসী অভিযোগ করেছেন, মিথ্যা মামলা হওয়ার পর এখন প্রায় প্রতিদিনই আসামি ধরার জন্য পুলিশ গ্রামে হানা দেয়।

এ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ফাতেমা বেগম বলেন, ‘তারা প্রথমে আমাদের চলে যেতে বলেছে, আমরা রাজি হইনি। আমরা এসপি সাহেবের কাছে গিছিলাম। তারপরে আরও খ্যাপে এখন চাঁদাবাজির মামলা দিছে। আমরা জমি ছাড়ব না।’

এ বিষয়ে আরেক ভূমিহীন নারী আকলিমা বেগম বলেন, ‘সাত-আট মাস আগে কোম্পানিওয়ালারা বলেছে তুমি এখানে থাকতি পারবা না। তারা আমার বাড়ির ওঠোনে বালি ফেলেছে। যত গাছগাছালি ছিল সব বালিতে আটকা পড়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরানো যায় না।’