দুবাইয়ে পারিবারিক দোকান ছেড়ে নতুন মাদক 'খাট' পাচার

নতুন মাদক ‘খাট’সহ গ্রেপ্তার হন নাজিমউদ্দিন (মাঝে)। ছবি: সংগৃহীত
নতুন মাদক ‘খাট’সহ গ্রেপ্তার হন নাজিমউদ্দিন (মাঝে)। ছবি: সংগৃহীত

বাবা-চাচার দোকান ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। সেই দোকান দেখভাল করতে দুবাইয়ে পাড়ি জমান তিনি। তবে শুধু দোকান দেখাশোনার কাজ করতে ভালো লাগেনি তাঁর। দ্রুত ধনী হওয়ার উপায় খুঁজে নেন। শুরু করেন মদ বিক্রি। শহরে মদের বার থেকে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসায়। শুরু করেন নতুন ধরনের মাদক ‘খাট’ পাচার। তবে গ্রেপ্তারের পরই জানা যায়, গ্রিন টি ব্যবসার আড়ালে তিনি মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছিলেন।

ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ‘খাট’-এর বিপুল পরিমাণ চালানসহ নাজিমউদ্দিন নামের ওই মাদক ব্যবসায়ীকে গত ৩১ আগস্ট গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে নাজিমউদ্দিন গ্রেপ্তার হলেও নতুন ধরনের এই মাদক দেশের ভেতর ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নাজিমউদ্দিনের বাবার নাম হাজি আনোয়ার আলী। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে নাজিম সবার বড়। তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের তেতৈতলা গ্রামে। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ গ্রামে তাঁরা বাস করেন। এর আগে একই উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের ছোট রায়পাড়া গ্রামে থাকতেন তাঁরা। নদীভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে আনোয়ার আলী সপরিবারে তেতৈতলায় চলে আসেন। তেতৈতলায় আসার পরপরই নাজিম তাঁর বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতে দুবাই পাড়ি দেন। সেখানে আনোয়ার আলীর দোকান ছিল।

স্থানীয় লোকজন জানান, নাজিমউদ্দিনকে তাঁরা লাভলু বলে ডাকতেন। প্রায় ২৫ বছর আগে লাভলু দুবাই যায়। তবে অনেক আগে থেকেই নাজিমের বাবা-চাচারা দুবাই থাকতেন। সেখানে তাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা আছে। বাবার মৃত্যুর পর নাজিমই ব্যবসার হাল ধরেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মাকসুদুর রহমানের বোনের সঙ্গে ১৩ বছর আগে বিয়ে হয় নাজিমের। নাজিমের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তাঁরা ঢাকায় থাকে।

কয়েক মাস পরপর দেশে আসেন নাজিম। ঢাকাতেও তাঁর ব্যবসা রয়েছে। রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে কাকরাইল ১২৪/৭/এ শান্তিনগর প্লাজার দোতলায় একটি কক্ষ সাত হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতে থাকেন নাজিম। তাঁর প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’। দোতলার অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির শেষ দিকে তাঁর এই অফিস। অফিসের দরজার ‘অরগানিক গ্রিন টি’র একটি স্টিকার লাগানো আছে। আশপাশের দোকানগুলোর কারও সঙ্গে তিনি মিশতেন না বলে জানা গেছে। এমনকি গ্রামের বাড়ি গেলেও কারও সঙ্গে মেলামেশা করতেন না নাজিম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাজিমের গ্রামের বাড়ির এক প্রতিবেশী বলেন, তাঁরা অনেক আগেই শুনেছেন, নাজিম বিদেশে মাদক ও নারী পাচারের ব্যবসা করেন। দুবাইয়ে তাঁর মদের দুটি বার রয়েছে। প্রতি ছয় মাস পরপর নাজিম দেশে আসেন। গ্রামের বাড়ি এলেও এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। সবশেষ এবার রমজান মাসের আগে দেশে আসেন নাজিম।

‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’ নামে গ্রিন টি-এর আড়ালে চলত ‘খাট’-এর ব্যবসা। ছবি: সংগৃহীত
‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’ নামে গ্রিন টি-এর আড়ালে চলত ‘খাট’-এর ব্যবসা। ছবি: সংগৃহীত

অরগানিক গ্রিন টি’র নামে ব্যবসা
গ্রিন টির নামেই ‘খাট’ নামে এই মাদকের ব্যবসা করতেন নাজিম। গত শুক্রবার দুপুরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ৪০০ কেজি নতুন এই মাদকের চালান জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর আগে সকালে নাজিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিমানবন্দর থেকে খাটের চালান জব্দ করার পর নাজিমকে নিয়ে তাঁর শান্তিনগরের অফিসে অভিযান চালানো হয়। সেখানে বিপুল পরিমাণ ‘খাট’ জব্দ করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাট’ আসলে নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস (এনপিএস) নামে এক ধরনের মাদক। আফ্রিকা থেকে গ্রিন টি নামে বাংলাদেশ আনতেন নাজিম। আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার এক নাগরিকের মাধ্যমে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে এনপিএস বাংলাদেশে আনেন। বাংলাদেশের অরগানিক গ্রিন টির প্যাকেট করে বিক্রি করেন। দেশে এক কেজি এনপিএসের দাম ১৫ হাজার টাকা। এখান থেকে এনপিএসের চালান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করতেন তিনি।

‘খাট’-এর বিস্তারে শঙ্কা
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম জানান, দুই মাস আগে এনপিএসের প্রথম চালান নিয়ে আসেন তিনি। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নাজিম অনেক আগে থেকে এই মাদকের ব্যবসা করছেন। তাঁদের ধারণা, কয়েক মাস পরপর কার্টনে করে খাটের চালান দেশে আনেন নাজিম। তাই ইতিমধ্যে ‘খাট’-এর বিস্তার ঘটেছে কি না, তা নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এ দেশে আসতে শুরু করে হেরোইন। এর অনেক আগে থেকে প্রচলন ছিল গাঁজার। হেরোইন আসার পর মাদকসেবীরা ঝুঁকে পড়েন এতে। এরপর ৯০ দশকে ভারত থেকে আসা শুরু হয় ফেনসিডিল। ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসাকে পেছনে ফেলে নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে থাবা দেয় ‘ইয়াবা’। প্রায় দেড় দশক ধরে চলছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা। এবার নতুন আরেক ধরনের মাদক ‘খাট’ আসা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। সেবনের পর এটি মানবদেহে ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে ফেনসিডিল-ইয়াবার মতো সীমান্ত পথে নয়, আকাশপথে এসেছে নতুন মাদক ‘খাট’।

‘খাট’ সেবনে যা হয়
‘খাট’ অনেকটা চায়ের পাতার গুঁড়োর মতো দেখতে। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে এটি সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে একধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আসক্তিটা অনেকটা ইয়াবার মতো। একধরনের গাছ থেকে এই ‘খাট’ বা এনপিএস তৈরি হয়। এটি ‘খ’ ক্যাটাগরির মাদক। আফ্রিকার দেশ জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে খাটের গাছ উৎপাদন করা হয়। ‘খাট’ সেবন করলে অনিদ্রা, অবসাদ, দৃষ্টিভ্রম, ক্ষুধা মন্দাসহ মানবদেহে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া ইন্দ্রিয় শক্তি এবং যৌনক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি খাট জীবনী শক্তিও কমিয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৯৮০ সালে এনপিএনকে মাদকদ্রব্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবার জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফের নামে খাটের চালানটি এ দেশে আনেন নাজিম। তবে তাঁর সঙ্গে বড় একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। এদের ধরতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।