সিগারেটের একটি ব্র্যান্ডের মূল্য জানিয়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা

তথ্য জানানোর কথা বলে সিগারেটের একটি ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ করে মোবাইল ফোনে পাঠানো হয়েছে খুদে বার্তা। এই বার্তায় ওই ব্রান্ডের সিগারেট কিনতে বলা হয়নি, তবে সিগারেটের দাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনের ভাষায় একে পরোক্ষ বা ইনডাইরেক্ট বিজ্ঞাপন বলা হয়।

সম্প্রতি বাংলাদেশে মোবাইলের খুদে বার্তায় একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের সিগারেটের দাম সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের তথ্য জানানো হয়েছে। তবে যে সিগারেট ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন পাঠানো হয়েছে, সে কোম্পানি বলছে, তারা এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কাউকে বলেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরও বলছে, মোবাইলে এ ধরনের খুদে বার্তা পাঠানো ঠিক হয়নি। এটা মূলত ওই ব্র্যান্ডকে পরিচিত করছে।

মোবাইলের খুদে বার্তায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন পাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নম্বর ও প্রেরকের পরিচয় গোপন করে তাঁদের এ ধরনের বার্তা পাঠানো হয়েছে। গত ৩ জুলাই এমন একজনের মোবাইল ফোনে আসা বার্তার ভাষ্য ছিল, ‘...সিগারেটের মূল্য প্রতি ২ শলা ১১ টাকা।’ বহুজাতিক একটি কোম্পানির ব্র্যান্ড এটি। বার্তাটিতে প্রেরকের কোনো নম্বর ছিল না। নম্বরের স্থানে লেখা ছিল ‘প্রাইজ অ্যালার্ট’। অর্থাৎ পরিচয় গোপন করে প্রাইজ অ্যালার্ট নামের তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই বার্তা পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, সিগারেটের এ ধরনের বিজ্ঞাপন ও প্রচার নিষিদ্ধ। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫-এ বলা হয়েছে, প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এই আইনে আরও বলা আছে, তামাকজাত দ্রব্য কিনতে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করতে কোনো নমুনা, বিনা মূল্যে বা কম দামেও সাধারণ মানুষকে দেওয়ার প্রস্তাব করা যাবে না। কিন্তু ওই খুদে বার্তায় বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ক্রেতাকে পণ্য কিনতে প্রলুব্ধও করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সাবেক কো-অর্ডিনেটর মো. রুহুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি এটা আইনের লঙ্ঘন। কারণ, এভাবে তারা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। এটাও একধরনের প্রমোশনাল কাজ।’

সিগারেটের এমন বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ই-মেইলে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজেটের পরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে সব সিগারেটের মূল্য গণবিজ্ঞপ্তি আকারে দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। সিগারেটের মূল্য কমল না বাড়ল, সেটা জানানোর জন্যই এই বিজ্ঞাপন দুটি প্রকাশ করা হয়। এর বাইরে আর কোনো প্রচারমূলক কার্যক্রম তারা চালায়নি।

তাহলে তাদের ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিজ্ঞাপন কীভাবে মোবাইলের খুদে বার্তায় এল, সে সম্পর্কে কোম্পানিটি বলছে, তাদের নাম ব্যবহার করে কেউ যদি এ ধরনের কাজ করে থাকে, সেটার দায়িত্ব যারা কাজটি করেছে তাদের। তাদের কোনো দায় নেই।

মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে প্রচারণার জন্য কোনো বার্তা গ্রাহকের কাছে পাঠায়, সেটার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। সিগারেটের এমন খুদে বার্তার বিষয়টি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অপারেটরদের নজরে আনা হলে এসএসএল ওয়্যারলেসের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চায় একটি অপারেটর। এসএসএল ওয়্যারলেস তাদের ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, সিগারেটের মূল্য পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে আইনে কোনো বাধা নেই বলেই তারা জানে। সেটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যেমন করা হয়, তেমনি নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে খুদে বার্তার মাধ্যমেও জানানো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনটেন্ট প্রোভাইডার (সিপি) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে গ্রাহকদের মোবাইল ফোনে এ ধরনের খুদে বার্তা পাঠানো হয়। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকের মোবাইলে বার্তা পাঠায়, এগুলো ‘পুশ ম্যাসেজ’ নামে পরিচিত। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। সিপি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ভাস (ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস) নীতিমালা তৈরি করেছে। এই নীতিমালা এখনো সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। মোবাইল ফোনের মৌলিক সেবার বাইরে যেসব অতিরিক্ত সেবা দেওয়া হয়, সেগুলোকে ভাস বলা হয়। এর মধ্যে আছে ওয়েলকাম টিউন, রিংটোন, গান শোনা, বিভিন্ন কোম্পানির সেবা নেওয়া ইত্যাদি।

ভাস সেবা দেওয়ার জন্য সিপি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট নম্বর থাকতে হয়। কিন্তু সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজটি যে প্রতিষ্ঠান করেছে, তারা নম্বর গোপন করে কাজটি করেছে। নম্বর গোপন রেখে মোবাইল বার্তা পাঠানোর এমন কাজকে বলা হয় মাসকিং। টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী, একজন গ্রাহককে মোবাইল ফোনে কল করতে বা বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রেরকের পরিচয় নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী মাসকিং সম্পূর্ণ অবৈধ একটি কাজ।

নম্বর আসে কীভাবে
সিপি প্রতিষ্ঠানগুলো নানা উপায়ে গ্রাহকের মোবাইল নম্বর ও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। এ জন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়। যেমন: মোবাইলে টাকা ভরানো বা রিচার্জের কাজ করা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে নম্বর বিক্রি করেন। আবার মেলা, সামাজিক অনুষ্ঠান, সেমিনারে অংশ নিতে গেলে অনেক জায়গায় মোবাইল নম্বর দিতে হয়। এ সব নম্বর কৌশলে একটি চক্র সংগ্রহ করে। পেশার ধরন, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, নানা শ্রেণিতে এসব নম্বর সংরক্ষণ করা হয়। এরপর একেক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুসারে এসব নম্বর বিক্রি করা হয়। পুরো কাজটিই হয় খুব গোপনে। তাই কত লোক বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবহারকারীর বিস্তারিত তথ্যসহ এভাবে মোবাইল নম্বর বিক্রি করে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।

নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে এসব বার্তা পাঠানোর কাজ করা হয়। ধরা যাক, মোটরগাড়ি বিক্রি করে একটি প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার লোকের কাছে খুদে বার্তা দিয়ে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চায়। কিন্তু ওই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে এত লোকের নম্বর নেই। তখন সিপি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঁচ হাজার সম্ভাব্য গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর নম্বর কিনে তাদের কাছে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। যেসব গ্রাহক ওই মোটরগাড়ির বিজ্ঞাপন খুদে বার্তায় পান, তাঁদের বেশির ভাগই বুঝতে পারেন না কীভাবে তাঁর নম্বর ওই কোম্পানি পেল। মোবাইলে এ ধরনের খুদে বার্তা পাঠানোকে বলা হয় ‘পুশ ম্যাসেজিং’। গ্রাহকের অনুমতি না নিয়ে গায়ের জোরে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিই হলো পুশ ম্যাসেজিং।

সিগারেটের বিজ্ঞাপনে নানা কৌশল
দেশে সিগারেটের মতো তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচার আইনত নিষিদ্ধ হলেও নানান কৌশলে চলছে এসব পণ্য প্রচারের কাজ। ছোট চায়ের দোকান ও ভ্রাম্যমাণ দোকানের মাধ্যমে সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। সিগারেটের ছবি বা কোম্পানির ছবি দিয়ে টং দোকানে বড় আকারের বাক্স থাকে। ইদানীং চায়ের কাপেও সিগারেট কোম্পানির স্টিকার লাগানো হচ্ছে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০০৯ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনে ৩ জন যেকোনো জায়গায় সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট হয়।

তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ভয়ের ব্যাপার। সিগারেট কোম্পানিগুলো আইন ভঙ্গ করে সিগারেটের দাম লিখে দোকানগুলোয় টাঙিয়ে দেয়। বাজেটের আগে বা পরে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।’ মোবাইলে বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলোর নতুন কৌশল। তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ করতে মোবাইলে বিজ্ঞাপনপন্থা তারা বেছে নিয়েছে। এ ধরনের কৌশল অব্যাহত থাকলে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে না। এসব নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন জরুরি।