সাফারি পার্কে জন্ম নিল সাদা বাঘিনী

মা ও বোনদের সঙ্গে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো
মা ও বোনদের সঙ্গে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো

তুলতুলে শরীর। নীল চোখ। ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মারছে। মায়ের নজর একটু অন্যদিকে গেলেই দেয় ছুট। কিন্তু মাকে ফাঁকি দেওয়া কি এত্ত সহজ! এক মাস বয়সী মেয়েটি ছুট দিলেই মা পথ আগলে রাখে। কাছে নিয়ে মুখ ঘষে দেয়। ধবল দেহটি জিব দিয়ে মুছে দেয়।

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে প্রথমবারের মতো জন্ম নেওয়া ডোরাকাটা সাদা রঙের বাঘের বাচ্চাটি এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। বাংলাদেশে এটি জন্ম নেওয়া তৃতীয় সাদা বেঙ্গল টাইগারের বাচ্চা। আর সাফারি পার্কে এটিই প্রথম শ্বেতাঙ্গ বেঙ্গল টাইগার। বাবা-মা ডোরাকাটা হলুদ রঙের হলেও এই বাচ্চা মেয়ে বাঘটি সাদা হয়েছে। তার সঙ্গে আরও দুটি বোন জন্ম নিয়েছে। সেগুলো অবশ্য বাবা-মায়ের রং পেয়েছে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সম্প্রতি একটি সাদা ডোরাকাটা বাঘের জন্ম হয়। সেটি দেশের প্রথম সাদা বাঘ। ওই সময় আরও একটি সাদা বাঘ জন্ম নেওয়ার পরদিন মারা যায়। ওই বাঘের বাচ্চার বাবা-মাও হলুদ ডোরাকাটা।

তবে বাবা-মা ডোরাকাটা হলুদ হলেও সাদা শাবক জন্ম নেওয়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা বাঘগুলোর পূর্বপুরুষ সাদা হয়ে থাকতে পারে। জিনগত কারণে বাবা-মা হলুদ রঙের হলেও এই বাচ্চা দুটো সাদা হয়েছে।

বোনের সঙ্গে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো
বোনের সঙ্গে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো

তিনি আরও বলেন, মানুষের মতো বাঘেরও শ্বেত রোগ হয়। সে ক্ষেত্রে শ্বেত রোগী বাঘগুলো জন্ম থেকেই সাদা থাকে। এগুলোর গায়ে কোনো ডোরাকাটা দাগ থাকে না। এই বাচ্চা দুটো ডোরাকাটা দাগ থাকায় বোঝা যাচ্ছে, জিনগত কারণে সাদা হয়েছে। এই বাঘগুলোর চোখের মণি নীল রঙের হয়।

রোববার গাজীপুর সাফারি পার্কে সরেজমিনে দেখা যায়, শ্বেত বাঘিনীকে ওর মায়ের মতোই আগলে রাখা হচ্ছে। পার্কের মিনি এনক্লোজারে নিরিবিলি থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে সাদা শাবকটি ওর দুটি বোন আর মায়ের সঙ্গে সারা দিন খেলা করে। একটু দৌড়ঝাঁপ। ক্লান্ত হলে আবার মায়ের কাছে ছুটে যায়। আরাম করে মায়ের হলদে ডোরাকাটা লোমশ দেহে মুখ ডুবিয়ে দুধ পান করে নেয়। এরপর আবার চলে ছুটোছুটি, খেলা। বিশ্রাম নিতেই চায় না। তাই সাদা বাঘের মায়ের চোখে যেন ঘুম নেই।

কদর বেশি থাকায় এখনই জনসমক্ষে আনা হয়নি সাদা বাঘশিশুকে।

গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে মাত্র মাসখানেক আগে শ্বেত বাঘিনীর জন্ম হয়েছে। সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ৮ আগস্ট সকালবেলা বেঙ্গল টাইগার পরিবারে তিনটি বাঘিনীর জন্ম হয়। শ্বেত বাঘিনীর বাবার নাম জ্যাকবল। মায়ের নাম দেওয়া হয়নি। নতুন শাবকগুলোরও নাম দেওয়া হয়নি। এই বাচ্চা বাঘগুলোর মায়ের এর আগেও তিনটি মেয়ে বাচ্চা হয়েছিল। সেগুলোর নাম জয়া, জ্যোতি ও মাধুরী। নতুন শাবক নিয়ে সাফারি পার্কে এখন মোট বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে তিনটি পুরুষ।

ছোট খাঁচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো
ছোট খাঁচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ডোরাকাটা সাদা বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো

বাঘের পালক নুরুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, অচেনা কাউকে দেখলেই বাঘের মা রেগে যায়। আর রোগাক্রান্ত যেন না হয় সে জন্য বিশেষ খেয়াল রাখা হয়। জন্মের পর বাইরের কোনো লোককে বাঘের সাদা বাচ্চাসহ অন্যদের দেখতে দেওয়া হয়নি। আরও বছরখানেক আড়ালেই রাখা হবে।

নুরুন্নবী বলেন, এখন বাচ্চাগুলো মায়ের বুকের দুধই কেবল পান করবে। মাস ছয়েক বয়স হলে অল্প স্বল্প করে মাংস দেওয়া হবে।

সাদা বাঘটি সুস্থ আছে জানিয়ে নুরুন্নবী বলেন, সব বাচ্চারই ওজন বাড়ছে। কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়নি।

পরিচর্যাকারীর কোলে সদ্য জন্মানো দুটি বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো
পরিচর্যাকারীর কোলে সদ্য জন্মানো দুটি বাঘের বাচ্চা। ছবি: প্রথম আলো

নুরুন্নবী জানান, তিন মাস আগে বাঘিনীর গর্ভধারণের বিষয়টি বুঝতে পারেন। এরপর থেকে মিনি এনক্লোজারে রাখা হয় মা বেঙ্গল টাইগারকে। তখন থেকে বাচ্চা জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত মা বাঘটিকে প্রতিদিন পাঁচ কেজি গরুর মাংস খেতে দেওয়া হতো। এক দিন খাবার দেওয়া হতো না। এ ছাড়া সপ্তাহে এক দিন জ্যান্ত একটি খরগোশ খাওয়ানো হতো। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর মাংস এক কেজি বাড়তি দেওয়া হচ্ছে। জীবন্ত খরগোশ খাওয়ানো বন্ধ। কারণ, জীবন্ত খরগোশ খেতে দিলে মা তার বাচ্চাদের একইভাবে খেয়ে ফেলতে পারে।

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, আপাতত বাঘের সাদা বাচ্চাকে মায়ের সঙ্গে রাখা হবে। এরপর কর্তৃপক্ষ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।

বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদা বাঘের আলাদা করে বিশেষ যত্ন নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ের সঙ্গে, ভাইবোনদের সঙ্গে রাখলেই চলবে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সম্প্রতি একটি সাদা ডোরাকাটা বাঘের জন্ম হয়। এটি দেশের প্রথম সাদা বাঘ। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সম্প্রতি একটি সাদা ডোরাকাটা বাঘের জন্ম হয়। এটি দেশের প্রথম সাদা বাঘ। ছবি: প্রথম আলো

অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, বনে সাদা বেঙ্গল টাইগারের জন্ম খুব কম হয়। সুন্দরবনে হয়ই না। তবে সাদা বাঘ দেখতে সুন্দর। জন্মও খুব কম হয়। তাই এর কদর বেশি। এই রঙের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নবজাতক সাদা বাঘকে নিকটতম আত্মীয়ের সঙ্গে রাখা উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি।

গত ১৯ জুলাই চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রথম সাদা বাঘশাবকের জন্ম হয়। একই সময় মোট তিনটি শাবক প্রসব করে বাঘিনী। এর মধ্যে একটি বাচ্চা জন্মের পরদিন মারা যায়। বাকি দুটি বাঘশাবক (বাঘিনী) বেঁচে আছে। মারা যাওয়া অপর শাবকটিও সাদা রঙের ছিল।

জন্ম নেওয়ার পর থেকে বাঘের খাঁচাটি ঢেকে দেওয়া হয়। এখনো সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি বাঘশাবকগুলোকে। মানুষের উপস্থিতিতে বাঘ ও বাঘিনী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে—এই আশঙ্কা ছিল চিড়িয়াখানার কর্মীদের মধ্যে। শুক্রবার ঢেকে দেওয়া পর্দা খানিকটা সরিয়ে এই ছবিগুলো তোলার অনুমতি দেয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।