অস্তিত্ব-সংকটে ইছামতী নদী

নদীর ভেতরে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটি। সম্প্রতি ঢাকার নবাবগঞ্জের শিকারীপাড়া ইউনিয়নের আনন্দনগর ঘাট এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নদীর ভেতরে তৈরি করা হয়েছে বাড়িটি। সম্প্রতি ঢাকার নবাবগঞ্জের শিকারীপাড়া ইউনিয়নের আনন্দনগর ঘাট এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার নবাবগঞ্জ সদরে ঢুকলেই ইছামতী দেখে বহতা নদীটির আগাগোড়া এক রকম মনে হতে পারে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। নদীর এই অংশটুকু খননের কারণে প্রবহমান থাকলেও বান্দুরা বাজার থেকে দৃশ্যপট আলাদা। দাউদপুর বাজার, বারুয়াখালী, শিকারীপাড়া ও জয়কৃষ্ণপুর হয়ে কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধ পর্যন্ত নদী মৃতপ্রায়। জবরদখল ও কাশিয়াখালীতে বাঁধ দেওয়ায় নদীটির অস্তিত্বই সংকটে পড়েছে।

গত ১২ আগস্ট কলাকোপা বাজার থেকে নদীতীর ঘেঁষে সড়কপথে গিয়ে দেখা গেল, বান্দুরা বাজার পর্যন্ত নদীর প্রবাহ মোটামুটি ঠিক আছে। দাউদপুর বাজার এলাকা থেকেই শুরু হয়েছে নদী দখলের প্রবণতা। দাউদপুর সেতুর পশ্চিম অংশে নদীতে গড়ে তোলা হয়েছে অন্তত চারটি পাকা দোকান। দোকান ভাড়া নেওয়া ব্যক্তিরা জানালেন, এগুলো তৈরি করেছেন এলাকার শাজাহান। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে শাজাহান বলেন, ‘এইটা আমার কিনে নেওয়া সম্পত্তি।’

মূলত দাউদপুর এলাকা থেকেই ইছামতীর স্রোত থমকে গেছে। দাউদপুর থেকে বারুয়াখালী হয়ে শিকারীপাড়া সেতুর ওপর গিয়ে দেখা গেল, সেতুর দুই তীর পর্যন্ত আড়াআড়ি বাঁশের খুঁটি ও জাল দিয়ে নদীতে বেড়া দেওয়া। এলাকার লোকজন বলছেন, এখান থেকে তিন -চার কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়া দিয়ে মাছ চাষ করছেন শিকারীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলীমুর রহমান খান। নদীতে এমন আট জায়গায় বেড়া দেওয়া।

দেখা যায়, শিকারীপাড়ার কাছে আনন্দনগর ঘাটসংলগ্ন শ্মশান ঘেঁষে প্রাসাদতুল্য বাড়ি। বাড়ির পেছনের অংশের সিঁড়ি নদীর মাঝবরাবর চলে গেছে। নৌকায় ওপাড়ে জয়কৃষ্ণপুর ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, কচুরিপানা সরিয়ে গোসল করছেন অশীতিপর আনন্দ হালদার, মো. পলাশ ও মৎস্যজীবী রুইদাস হালদার। কয়েক বছর আগের স্মৃতিচারণা করে রুইদাস বলেন, ‘আমাগো সম্প্রদায় এই নদী বাইয়্যা খাইত। মাছের অভাব আছিল না। কাশিয়াখালীর বানটাই (বাঁধ) নদীডা শেষ কইর‍্যা দিল।’ শ্মশান কমিটির সভাপতি মন্তোষ হালদার এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘হিন্দুরা ডরে এইডা নিয়্যা কথা কইব না।’ তবে বাড়ির মালিক মাজেদুর রহমান বলেন, ‘নিজের জায়গার ওপর আমি বাড়ি করেছি।’

আলিমুর রহমান দাবি করেন, এক বছর আগেই তিনি নদী থেকে সব ধরনের বেড়া উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু নদীতে এখনো বাঁশ-জালের বেড়া দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে আলিমুর বলেন, ‘আপনি ভুল দেখেছেন।’

ইউএনও মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগে নদী কমিশনের এক সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে দখল পরিস্থিতি সরেজমিন করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কলাকোপায় ইছামতীর প্রবহমান অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণের ঘটনা ঘটেছে। আমরা মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এগুলো উচ্ছেদ করার চেষ্টা করি। কিন্তু নদীর পুরো অংশে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করার মতো লোকবল আমাদের নেই।’ নদীতে বেড়া দিয়ে মাছ চাষ বন্ধে সম্প্রতি আলিমুরকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেছেন বলে জানান তিনি। সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহনাজ মিথুন জানান, ইছামতী দখলের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

ইছামতী নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি মেজর (অব.) সুধীর সাহা বলেন, ‘ইছামতীর এসব দখলদারের বিষয়ে আমরা নানাভাবে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। আমাদের দাবি, অবিলম্বে কাশিয়াখালী বাঁধের উৎসমুখে একটি জলকপাট বসিয়ে নদীর প্রবাহ সচল রাখা হোক। এটা না হলে ইছামতী বাঁচানোর কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না।’