নতুন করে হামলার আশঙ্কা পাহাড়ের মানুষকে চেপে ধরেছে

১৮ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সুনশান খাগড়াছড়ি শহরের স্বর্নিভর বাজার এলাকা।  ফাইল ছবি
১৮ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সুনশান খাগড়াছড়ি শহরের স্বর্নিভর বাজার এলাকা। ফাইল ছবি
>
  • হত্যা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না
  • স্বজন হত্যার বিচার চাইতেও ভয়
  • মামলা করার সাহস নেই কারও

বারবার হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনায় রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। সর্বশেষ খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে ছয় খুনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নতুন করে হামলার আশঙ্কা বাসিন্দাদের চেপে ধরেছে। হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পাহাড়ের বিবদমান দল ও প্রশাসনও।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনায় ৩৬ জনের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে সব পক্ষকে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজন সাধারণ মানুষ। বাকিরা পাহাড়ের আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের নেতা-কর্মী।

আতঙ্কের বিষয়টি স্বীকার করে খাগড়াছড়ির সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, এই সংঘাত প্রত্যাশিত নয়। সাধারণ মানুষের মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।

সাধারণের ভয়

একের পর এক হামলায় এখন সাধারণ মানুষ মুখ খুলতেও নারাজ। পাহাড়ের হানাহানির বিষয়ে একটি শব্দও বলছেন না তাঁরা। গত ৩০ আগস্ট স্বনির্ভর বাজারের এক দোকানি স্পষ্টই বললেন, ‘এসব বিষয়ের মধ্যে আমাদের জড়াবেন না। আমরা নিরীহ মানুষ। এমনিতে ভয়ে আছি। আবার কোন বিপদে পড়ি...।’

এখন সন্ধ্যা নামলেই অনেকটা ফাঁকা হয়ে পড়ে খাগড়াছড়ির পথঘাট। ২৯ আগস্ট কথা হয় খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন কার্যালয়ে দুই বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁদের একজন সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মী। পাহাড়ের অবস্থা কেমন—জানতে চাইতেই তিনি বললেন, ‘অন্য কথা বলেন। মারামারি নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।’

স্বনির্ভর বাজারের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন সাধারণ মানুষ। তাঁদের একজন মহালছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মী জিতায়ন চাকমা। জিতায়নের কথা মনে করিয়ে দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী বললেন, ‘দেখছেন না উনি ঘটনার শিকার হয়ে গেলেন। কী অপরাধ ওনার?’

রাঙামাটির নানিয়ারচরে সবচেয়ে বেশি, ছয়টি হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯ মাসে। মারা গেছেন ১০ জন। তাঁদের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা অন্যতম।

বিচার চান না স্বজনেরা!

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ পরিবারও স্বজন হত্যার বিচার চায় না। অনেক পরিবার মামলাও দেয়নি। কাউকে কাউকে জোর করে বাদী হিসেবে সই নেওয়া হয়েছে। একধরনের ভয় ও আতঙ্ক তাঁদের মধ্যে কাজ করছে। পরিবারগুলোর ওপর প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় চাপও রয়েছে বলে অভিযোগ।

খাগড়াছড়িতে গত ১৬ এপ্রিল ইউপিডিএফ নেতা সূর্য বিকাশ চাকমা গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী রিপনা চাকমা বাদী হয়ে মামলা করেন। দুই ছেলে নিয়ে তিনি খাগড়াছড়ির বাইরে থাকেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি মামলা করতে বাধ্য করেছে। বিচার কার কাছে চাইব?’

গত ২১ মে পানছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ নেতা সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা। এই খুনের মামলার বাদী তাঁর স্ত্রী অলকা ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘আমি এ মামলার কথা কিছু জানি না।’ বিচার চান কি না— জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

স্বনির্ভর বাজার থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা দূরত্বে খবংপুড়িয়া এলাকায় নিহত জিতায়ন চাকমার বাড়ি। ক্ষোভের সঙ্গে জিতায়নের দুই মেয়ে বলেন, ‘কার কাছে বিচার চাইব?’ মিঠুন চাকমা মারা যান গত ৩ জানুয়ারি। গত ২৯ আগস্ট খাগড়াছড়িতে তাঁর স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। মিঠুনের ফুফু লালসা চাকমা মুঠোফোনে বলেন, ‘যে গেছে সে চলে গেছে। এ নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। মরার সঙ্গে কে মরবে।’

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আলী আহমদ খান (সদ্যবিদায়ী) তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউন্টার হবে না? অবশ্যই আশঙ্কা আছে। এতগুলো মানুষ মারল। অপরপক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।’ রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরও হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি।

হামলা পাল্টা-হামলার ঘটনা মূলত তিনটি আঞ্চলিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলো হচ্ছে ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)।

জানতে চাইলে ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ সন্ত্রাসী দল নয়। প্রশাসনের সহযোগিতায় নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা আরও হামলা করতে পারে।’

নতুন করে হামলার আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেন, ‘ঘটনা একবার শুরু হলে সেটা থামানো কষ্টকর। তবে যেহেতু চারটি দল রয়েছে, সেখানে নতুন করে হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছি না। কারণ, ইউপিডিএফ সংঘাত করতে চায়।’