বেকারত্ব ঘোচাচ্ছে তোয়ালে

বাড়ির আঙিনায় তোয়ালের সুতা রোদে শুকানো হচ্ছে। কালীগঞ্জের উত্তরগাঁও এলাকায়।  প্রথম আলো
বাড়ির আঙিনায় তোয়ালের সুতা রোদে শুকানো হচ্ছে। কালীগঞ্জের উত্তরগাঁও এলাকায়। প্রথম আলো

টঙ্গী-ঘোড়াশাল সড়কের গাজীপুরের কালীগঞ্জের বাসস্ট্যান্ড। পশ্চিম দিকে লেভেল ক্রসিং হয়ে কিছু দূর এগোলেই খঞ্জনা গ্রাম। গ্রামটির রাস্তা ধরে হাঁটলে পাওয়া যায় খট খট শব্দ। ডান-বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে বাড়ির আঙিনায় নানান রঙের সুতা। বাঁশ টাঙিয়ে সেগুলো শুকানো হচ্ছে। একটি বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, কারখানায় সুতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে তোয়ালে। এই কারখানা স্থানীয় জালাল উদ্দিনের।

শুধু খঞ্জনা গ্রাম নয়, গত মঙ্গলবার সরেজমিনে আশপাশের প্রায় সব কটি গ্রামেই কমবেশি এ দৃশ্য দেখা যায়। জালাল উদ্দিন জানান, প্রায় ২০ বছর আগে তিনি তিনটি পাওয়ারলুম দিয়ে টিনের ছাপরায় কারখানা চালু করেন। ধারদেনা ও ব্যবসায়িক আয় থেকে বর্তমানে ছয়টি পাওয়ারলুম করেছেন তিনি। এ দিয়ে চলে তাঁর ছয়জনের সংসার। কারখানায় কাজ করছেন ২০ জন শ্রমিক। তাঁদেরও অভাব ঘুচেছে। তিনি জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম কেয়া টেক্সটাইল। শুরুর দিকে গ্রামে তিনি একাই এ ব্যবসা করতেন। এখন উপজেলায় প্রায় ৭০ জন তোয়ালে ব্যবসায়ী আছেন।

গ্রামবাসী জানান, তোয়ালে কারখানা কালীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার মানুষের বেকারত্ব কমিয়েছে। খঞ্জনা, বড়নগর, উত্তরগাঁও, কুমারটেক, বালিগাঁওসহ বিভিন্ন গ্রামে তোয়ালে তৈরি হচ্ছে। এসব গ্রাম তোয়ালের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

খঞ্জনা গ্রামের নূরুল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই তোয়ালে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে আসছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামটির অনেকেই তোয়ালে তৈরি শুরু করেন। নূরুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে বাবার করা একটি টিনের ঘরে দুটি পাওয়ারলুম দিয়ে ব্যবসা চালু করি। বর্তমানে আমার কারখানায় ছয়টি পাওয়ারলুম।’ তিনি বলেন, স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়া গেলে এ ব্যবসা আরও দ্রুত বিস্তার লাভ করত। বেকারত্ব আরও কমত। নূরুল ইসলামের মতো বড়নগর গ্রামের হাসান আলী, সফিজ উদ্দিন ও জলিল মিয়া ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা টিনের ঘর থেকে পাকা দালানও করেছেন।

তোয়ালে কারখানার ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায় দুই যুগ আগে খঞ্জনা গ্রামে শুরু হয় তোয়ালে তৈরি। গ্রামের কয়েকজন তোয়ালে তৈরি করে বেশ লাভবান হন। আশপাশের এলাকায় এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে শুরু হয় তোয়ালে তৈরি। তাঁদের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের তোয়ালে ও রুমাল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। এভাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। ব্যবসায়ীরা জানান, কালীগঞ্জের তোয়ালে ঢাকার সদরঘাট, চকবাজার ছাড়াও সিলেট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়।

কেয়া টেক্সটাইলে কর্মরত শ্রমিক রবিউল ইসলাম জানান, ১৮ বছর ধরে তিনি এ কারখানায় কাজ করছেন। বিভিন্ন আকারের তোয়ালের মজুরি ৫ থেকে ১৩ টাকার মধ্যে। তিনি যে আকারের তোয়ালে বোনেন, তার প্রতিটির মজুরি ছয় টাকা। দিনে কমপক্ষে ৬০টি তোয়ালে বুনতে পারেন তিনি। কাজ বেশি থাকলে এর চেয়ে বেশি বুনতে হয়। এই আয়েই তাঁর সংসার চলে।

উপজেলার ভাদগাতি গ্রামের সাফির উদ্দিনের মালিকানাধীন আলমগীর ডাইং কারখানার শ্রমিক জনি মিয়া জানান, এক যুগের বেশি সময় ধরে তোয়ালেশিল্পের সঙ্গে যুক্ত তিনি। আয়ও ভালো। তাঁর স্ত্রী আয়েশা বেগমও একই কারখানায় কাজ করেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, অনেকে ব্যাংক ও এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছেন। কম সুদে ঋণ পেলে তাঁরা ভালো ব্যবসা করতে পারতেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা তাঁতি সমিতির সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন জানান, কালীগঞ্জের বালিগাঁও, উত্তরগাঁও, যুগলী, কিশোরপুর, দক্ষিণবাগ, খঞ্জনা, ঈশ্বরপুর, জামালপুর, খলাপাড়া, যেতুয়া, চৌড়া, বড়নগর, ভাদগাতি, মোয়ানী, টাঙ্গাইয়া ও দেওয়ালের টেক গ্রামের তোয়ালে কারখানার প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাওয়ারলুমে বর্তমানে সাড়ে আট হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি জানান, শুরুর দিকে হ্যান্ডলুম ব্যবহার করে তোয়ালে তৈরি হতো। তবে বর্তমান এর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। হ্যান্ডলুমের পরিবর্তে পাওয়ারলুমের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। এখানকার তৈরি তোয়ালে মালয়েশিয়া, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হচ্ছে। এ শিল্পের আরও বিকাশ এবং দেশের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য তিনি সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।