জাহাজের ক্যাপ্টেন খুন হননি, ৭ তলা থেকে পড়ে গেছেন

জাহাজের ক্যাপ্টেন রফিকুল হাসান রিমনকে (৪২) কেউ খুন করেননি। সাততলা থেকে পড়ে তিনি নিহত হন। প্রায় ১০ মাস তদন্তের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ঢাকার আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে এ কথা জানিয়েছে।

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর শুক্রাবাদের একটি নির্মাণাধীন বাড়ির নিচতলা থেকে রফিকুলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রফিকুলের বাবা খলিল উল্লাহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। তবে আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশ যা বলেছে, তা মানতে নারাজ খলিল উল্লাহ। সাবেক শিক্ষক খলিল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলেকে খুন করা হলো। অথচ পুলিশ বলছে, সাততলা থেকে পড়ে নাকি মারা গেছেন। কে তাঁর ছেলেকে সেখানে নিয়ে গেল?

এ মামলায় ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।


পুলিশ প্রতিবেদনে বলেছে, ‘রফিকুল ইয়াবা সেবন করার পর প্রতিবারের মতো হাত–মুখ ধোয়ার জন্য মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে পানির কলের দিকে যাওয়ার সময় পথভ্রষ্ট হয়ে লিফটের খালি জায়গায় পড়ে মারা গেছেন বলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যে ১০ তলা ভবনের নিচে রফিকুলের লাশ পাওয়া যায়, তা নির্মাণাধীন একটি ভবন। বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ না থাকলেও পানির সংযোগ আছে। নেশাখোররা মোবাইলের আলোয় ভবনে আসা-যাওয়া করে। বাড়ির কোনো ব্যবস্থাপক নেই। তবে রফিক নামের একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও তিনি বেতনভুক্ত নন। বাড়ির সামনে ভ্যানে করে তিনি সবজি বিক্রি করেন। এ কারণে ওই বাসায় কে বা কারা ঢুকত, তা তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব না।

কীভাবে লাশ পাওয়া যায়
দুই সন্তানকে নিয়ে সেদিন (২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর) রফিকুল নিউমার্কেট এলাকায় যান। স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ায় এক বন্ধুর মাধ্যমে দুই সন্তানকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরে এলিফ্যান্ট রোডে একটি হোটেলে বন্ধু রিপনের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসার কথা বলে রফিকুল যান ধানমন্ডিতে।


রাত নয়টার দিকে মোবাইল ফোনে মামাতো বোন মিতুর সঙ্গে কথা বলেন রফিকুল। এরপর থেকে রফিকুলের মোবাইল ফোন বন্ধ পান বাবা খলিল উল্লাহ। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ওই ভবনের নিচ থেকে রফিকুলের মোবাইল ফোন পান সোহেল নামের একজন মুরগি বিক্রেতা। পরে রফিকুলের আত্মীয়স্বজন সেখানে গিয়ে রফিকুলের লাশ শনাক্ত করেন। রফিকুলের বাবা নিউমার্কেট থানায় মামলা করে বলেন, খুন করার পর তাঁর ছেলের লাশ সেখানে গুম করে রাখে অজ্ঞাত খুনিরা। মৃতদেহের নাক ও মুখে রক্ত, কানের পাশ থেঁতলানো ছিল। মুখ কালচে রং ধারণ করে।

দুজন গ্রেপ্তার
মামলার পর দুই দিনের মাথায় পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে সাজেদুল করিম রনি নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সাজেদুলকে আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ড চায় পুলিশ। রফিকুলের বাবা খলিল উল্লাহ জানান, সাজেদুল তাঁর বোনের মেয়ের ছেলে। সম্পর্কে নাতি হয়। ফ্ল্যাট নিয়ে তাঁর সঙ্গে রফিকুলের দ্বন্দ্ব চলছিল। এ ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি। সাজেদুলকে তিন দিন পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন আদালত।


এরপর গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় কাইয়ুম বাহার (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে। কাইয়ুমকে আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ড চেয়ে পুলিশ আদালতকে বলে, নিহত ব্যক্তির দেহে জখমের চিহ্ন ছিল। এ আসামিসহ সহযোগীরা মিলে রফিকুলকে খুন করতে পারে বলে সন্দেহ হচ্ছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) রাজ্জাক হোসেন শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, রফিকুল সেদিন ওই ভবনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে সাততলা থেকে পড়ে তিনি নিহত হন। এ মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে।

আদালতকে দেওয়া প্রতিবেদনে পুলিশ কর্মকর্তা রাজ্জাক বলেন, রফিকুল আগে একসময় কলাবাগান এলাকায় থাকতেন। সেখানে তাঁর বন্ধুবান্ধব ছিল, যাঁদের কেউ কেউ নেশাখোর। এর কয়েক দিন আগে রফিকুলের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, জাহাজ থেকে ফেরার পর তাঁর সন্তানেরা সপ্তাহে পাঁচ দিন মায়ের কাছে থাকবে, দুদিন থাকবে রফিকুলের কাছে। সন্তানদের স্ত্রীর কাছে দিয়ে আসার পর বন্ধু রিপনকে রফিকুল বলেন, তিনি উত্তরায় যাবেন। ৩০ মিনিটের মধ্যে ধানমন্ডিতে গিয়ে আবার ফিরে আসবেন। পরে শুক্রাবাদের পরিত্যক্ত ভবনে উঠে নেশা করার পর লিফটের খালি জায়গা থেকে পড়ে মারা যান। এর আগে রফিকুল মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন।

মামলার আরেক তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, রফিকুল ওপর থেকে পড়েই মারা গেছেন। রফিকুলের বন্ধুরাই এসব তথ্য দিয়েছেন।

লাশ উদ্ধারের সময় সেখানে উপস্থিত সাক্ষী অহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সাততলা থেকে কেউ পড়ে গেলে লাশ আরও ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কথা।

নিহত রফিকুলের বাবা খলিল উল্লাহ বলেন, পুলিশ বলছে, তাঁর ছেলে খুন হননি, তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁর ছেলেকে ডেকে নিয়ে সেখানে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে।