বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সেই ২ কর্মকর্তা কারাগারে

দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) দুই কর্মকর্তাকে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালত। আজ মঙ্গলবার বগুড়া জেলা অতিরিক্ত জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ও ভারপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শ্যাম সুন্দর রায় এই নির্দেশ দেন।

জেলহাজতে যাওয়া দুই কর্মকর্তা হলেন বিউবোর মহাব্যবস্থাপক দপ্তরের প্রকল্প পরিচালক (প্রধান প্রকৌশলী) মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও অতিরিক্ত পরিচালক এ এইচ এম তসলিম হোসেন। তবে একই মামলায় অপর আসামি বগুড়ার কটন স্পিনিং কোম্পানি লিমিটেডের মালিক মো. তৌফিকুর রহমানকে জামিন দিয়েছেন আদালত।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বগুড়া জেলা সমন্বিত দুর্নীতি দমন কমিশনের কোর্ট পরিদর্শক (বিশেষ বিচার প্রসিকিউশন ইউনিট) নিশীথ কুমার ঘোষ।

আদালত ও দুদক সূত্রে জানা যায়, বগুড়া কটন স্পিনিং কোম্পানি ১৯৬৮ সালে ৩২ হাজার টাকা জামানত রেখে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে সংযোগ নেয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তাদের কোনো বকেয়া বিল ছিল না। পরবর্তী সময় গ্রাহক (কোম্পানির মালিক) অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ করেন। কখনো কিস্তিতে পরিশোধ করতেন। পরে বকেয়ার দায়ে ১৯৯১ সালে ওই কোম্পানির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৯৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত গ্রাহকের অনুকূলে সর্বনিম্ন বিল জারি করা হয়। বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী, বিলম্বিত মোট বিলের ওপর বা এর খণ্ডাংশের জন্য ২ শতাংশ হারে দিতে হয়। সে মোতাবেক ২০০২ সালে কোম্পানির বিদ্যুৎ বকেয়া বিল হয় ৫২ লাখ ১৬ হাজার ৪৩৫ টাকা এবং সারচার্জ ২ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার ৭৭৩ টাকা। এই টাকার বিপরীতে ২০০৮ সালে বিদ্যুৎ আদালত ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে।

পরে এ বিল সংশোধনের জন্য বিউবোর চেয়ারম্যান বরাবর ২০১১ সালে দুটি আবেদন করেন তৌফিকুর। আবেদনের প্রেক্ষাপটে বিউবো চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষে গ্রাহকের কাছে ১৯৮৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৯১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিমান্ড চার্জ ২ লাখ ৮ হাজার টাকাসহ আসল ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮৬ টাকা ও সারচার্জ ১ কোটি ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ৯১৩ টাকা বকেয়া আদাযোগ্য বলে জানায়। ২০১১ সালে এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। কিন্তু আসামি এ এইচ এম তসলিম সারচার্জের বিষয়টি গোপন রেখে অন্যান্য বিল আদায়ের সিদ্ধান্তে সংশোধিত বিল মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক পরিচালন) ও সদস্যের (বিতরণ) কাছে উপস্থাপন করেন। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক গ্রাহক তৌফিকুর বগুড়া বিউবোর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগে ২২ লাখ ৫৩ হাজার ২৮৬ টাকা ইস্যু করেন ২০১১ সালের নভেম্বরে। এই বিলে কোনো সারচার্জ দেননি তিনি।

পরে বগুড়া বিউবোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, তদন্ত কমিটির সুপারিশকৃত সারচার্জ আদায় হবে কি না। এর পরিপ্রেক্ষিতে তসলিম হোসেন ব্যাখ্যা দেন, ‘সংশোধিত বিল গ্রাহক নির্ধারিত তারিখের মধ্যে পরিশোধ করেছেন বিধায় এ ক্ষেত্রে সারচার্জ বা সুদের প্রশ্ন থাকে না। গ্রাহকের সংশোধিত বকেয়া আদায়, নিরাপত্তা জামানত সমন্বয় ও সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন, বিধায় দেনা-পাওনা নিষ্পন্ন বিবেচনা করা যায়।’ এই ব্যাখ্যার পর প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান এটি মহাব্যবস্থাপকের কাছে দেন। একই সঙ্গে বিষয়টি সঠিক বলে তিনি তাতে স্বাক্ষরও করেন ২০১২ সালে। কেবল তা-ই নয়, এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত পোষণ করে মহাব্যবস্থাপকের পক্ষে এই ‘ব্যাখ্যা পত্রে’ স্বাক্ষর করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

পরে বিদ্যুৎ আদালত বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানালে ২০১৬ সালে বিউবো আবার চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই তদন্ত কমিটি আসল (২২ লাখ ৫৩হাজার ২৮৬ টাকা) ও সারচার্জ (২ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯৬ টাকা) আদায়ের পক্ষে প্রতিবেদন জমা দেয়। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয়েছে আগেই। আর সারচার্জ আদায়যোগ্য বলে জানায় কমিটি।

বিষয়টি তদন্ত শেষে গত ৮ আগস্ট বগুড়া আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের সহাকারী পরিচালক আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকের ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বকেয়া ৭৫ মাসের বিলের মধ্যে ৪৮ মাসের সঠিক ছিল। এই কারণে তা সংশোধন করা হয়নি। গ্রাহক বিল পরিশোধ করতে দেরি করায় সারচার্জ বেশি হয়েছে। এবং এটি অবশ্যই আদায়যোগ্য। এটি মওকুফ করা বিধি-বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

আল আমিন আরও বলেন, সংশোধিত বিলের সঙ্গে অসংশোধিত বিলের সারচার্জ ‘প্রযোজ্য নয়’ সিদ্ধান্ত দিয়ে আসামিরা তা আত্মসাৎ করতে চেয়েছেন। এটি দণ্ডবিধির ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের (৫২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এরপর এ মামলায় আসামিরা হাইকোর্ট থেকে ৬ সপ্তাহের অগ্রিম জামিন নেন। দুদক পরিদর্শক নিশীথ কুমার ঘোষ বলেন, আজ এই জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই কারণে আসামিরা বগুড়া আদালতে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও এ এইচ এম তসলিম হোসেনের জামিন না বাড়িয়ে তাঁদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

দুদকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আবুল কালাম আজাদসহ তিনজন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন রেজাউল করিমসহ আরও তিনজন।