১৯ বছর পর দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেন তিনি!

দুর্নীতির একটি অভিযোগ নিয়ে ১৯ বছর কাটিয়ে দিতে হয়েছে তাঁকে। অবশেষে অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকায় তিনি পেলেন দায়মুক্তি। সম্প্রতি তাঁকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এই ব্যক্তির নাম মো. আবদুল আউয়াল। বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ১৯৯৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। ওই সময় তিনি কর্মরত ছিলেন সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে। জানা গেছে, আবদুল আউয়ালের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসি খানমের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু হয়। তিনিও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

জানা গেছে, মো. আবদুল আউয়াল পরে রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৬ সালে জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে অবসরে যান তিনি। বর্তমানে তিনি ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। বসবাস করছেন রাজধানীর ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমন অনেক অভিযোগই আছে, যা বছরের পর বছর ফাইলবন্দী হয়ে আছে। অনুসন্ধান ঝুলে থাকায় অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হয়রানির মধ্যে থাকেন। আবার সঠিক অনুসন্ধান না হওয়ায় অনেক দুর্নীতিবাজ পারও পেয়ে যান। অনেককে রহস্যজনক কারণেও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।

দুদক সূত্র জানায়, সম্প্রতি এ অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ করে তাঁদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া নথি ও সব কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, আবদুল আউয়ালের সম্পদের পরিমাণ তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। রেকর্ডপত্রে দেখা গেছে, তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৮৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকার। ওই সম্পদের বিপরীতে তাঁর আয়ের উৎস ৯০ লাখ ৭ হাজার ২৯৪ টাকা।

একইভাবে তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী খানমের সম্পদের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৫৪ লাখ ৪ হাজার ৮৩৩ টাকার। আর আয়ের উৎস রয়েছে ৬৭ লাখ ৬৩ হাজার ৯৩৩ টাকার। এসব দিক বিবেচনায় তাঁর সম্পদের পরিমাণ তাঁর আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রয়েছে। তাঁদের আয়-ব্যয়ের তথ্য ও সম্পদের বিবরণী দীর্ঘদিন থেকে তাঁদের আয়কর নথিতেও উল্লেখ আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সব বিবেচনায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাঁদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করেন।

এ সুপারিশ চলতি মাসে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে উপস্থাপন করা হলে তিনি বিস্মিত হন। একজন মানুষ নির্দোষ হলে ১৯ বছর তাঁকে কেন হয়রানি করা হলো—সে বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন দুদক চেয়ারম্যান। সংস্থার মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরীকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অব্যাহতির নথিতেই নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এর পেছনে কার বা কাদের দায় রয়েছে, তা খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান।

দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে আবদুল আউয়ালের ধানমন্ডির বাসায় গেলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। বাড়ির নিচতলা থেকে নিরাপত্তারক্ষীর মাধ্যমে ইন্টারকমে কথা বলতে চাইলে তাঁরা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের আত্মীয় পরিচয়দানকারী একজন বলেন, এ অভিযোগ নিয়ে পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণায় ছিল। সামাজিকভাবেও অনেকের কটু কথা শুনতে হয়েছে তাঁদের।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৪ সালে যখন দুদক গঠন করা হয়, তখন ব্যুরোর আমলের প্রায় ১০ হাজার অভিযোগ অনুসন্ধান বা তদন্তাধীন ছিল। বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য তখন দুদকে ‘অনিষ্পন্ন বিষয়াদি’ নামে আলাদা একটি সেল গঠন করা হয়।

গোলাম রহমান আরও বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি যখন দুদক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে অবসরে আসি, তখন পর্যন্ত তিন-চতুর্থাংশ অভিযোগ নিষ্পন্ন হয়েছিল। গত কয়েক বছরেও বাকিগুলো যে শেষ হয়নি, তা আমার জানা ছিল না।’ তিনি বলেন, এর কারণে অনেকে দুর্ভোগে পড়েছেন, অনেকে দুর্ভোগ সয়েছেন এটি সত্য। এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতা সমর্থন করা যায় না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটা অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য বিশাল বিড়ম্বনা। একই সঙ্গে তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও শামিল। ছোট একটি ঘটনা হলেও এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়েই দুদকের প্রতি আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হয়। যেহেতু এটা স্বাভাবিক একটি ঘটনা নয়, তাই এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করা উচিত। বিশেষ করে সংস্থাটির দায়িত্বশীল কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।