ফেব্রুয়ারি গেল অভিযানও ফুরোল

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর গুলশান এলাকার এই দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা ছিল বাংলায়। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সাইনবোর্ডের বাংলা লেখা উঠে গেছে।  ছবি: প্রথম আলো
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর গুলশান এলাকার এই দোকানের সাইনবোর্ডের লেখা ছিল বাংলায়। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সাইনবোর্ডের বাংলা লেখা উঠে গেছে। ছবি: প্রথম আলো

বিদেশি দূতাবাস ও প্রতিষ্ঠান বাদে দেশি প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। অথচ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় ইংরেজি হরফে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ছে হরহামেশা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ ঘটা করে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ভাষার মাস শেষ হতেই লোক দেখানো অভিযান থেমে গেছে।

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, মগবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, দোকানের বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। এমনকি যারা আইন প্রয়োগ করবে, সেই সিটি করপোরেশন ভবনের আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও ইংরেজিতে লেখা।

সাতমসজিদ রোডে একটি নতুন বহুতল ভবনের বাইরের অংশে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টানানো। অধিকাংশই রেস্তোরাঁ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। এমনকি ভবনটির নামফলকও বড় ইংরেজি হরফে লেখা। তবে চারটি প্রতিষ্ঠান ইংরেজিতে লেখা বিশাল সাইনবোর্ডের পাশে ছোট করে পৃথক ব্যানারে বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে টানিয়েছে।

এই ভবনের ২০০ গজের মধ্যে আরেক ভবনে আছে অন্তত আটটি রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডও ইংরেজিতে লেখা। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সদ্য নির্মিত একটি ভবনে চালু হয়েছে আটটি রেস্তোরাঁ। ভবনের বাইরে টানানো প্রতিটি রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা।

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, দপ্তরের নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। পরে ২০১৪ সালের ২৯ মে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার মাধ্যমে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাগজে-কলমেই আটকে আছে সে সিদ্ধান্ত।

ইংরেজিতে সাইনবোর্ড টানানো ধানমন্ডির ১৫টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁদের অনেকেই জানেন না বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক। আবার অনেকে যুক্তি দেখান, ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো ইংরেজি ভাষার। সে কারণে সাইনবোর্ড ইংরেজিতে বানানো হয়েছে।

তবে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযানকে চলমান প্রক্রিয়া বলে দাবি করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত সাইনবোর্ডের বিষয়েও ব্যবস্থা নেন। যেহেতু ট্রেড লাইসেন্সের সময় বাংলায় সাইনবোর্ড করার বিষয়টি উল্লেখ থাকে। প্রয়োজনে ইংরেজিতে সাইনবোর্ড করা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা করা হবে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের ওই দোকানের সাইনবোর্ড।  ফাইল ছবি
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের ওই দোকানের সাইনবোর্ড। ফাইল ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় সাইনবোর্ডের ভাষার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। তারপরও অনেকে সেটা অনুসরণ করেন না। সেসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের রয়েছে। অথচ সিটি করপোরেশন কখনোই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

গত মঙ্গলবার গুলশান ২ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গোলচত্বরে অবস্থিত একটি বিপণিবিতানের নিচতলায় ফুজি কালার ফটো ওয়ার্ল্ডের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। ফেব্রুয়ারি মাসে এই সাইনবোর্ডটি সাদা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।

গুলশান ২ নম্বরে ডিএনসিসির নগর ভবনের বিপরীত পাশেই নিউ ক্লাসিক ফেব্রিকস প্রতিষ্ঠানটির সাইনবোর্ড ইংরেজি হরফে লেখা। ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রতিষ্ঠানটিও ইংরেজি সাইনবোর্ডের ওপরে বাংলায় লেখা ব্যানার টানিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাস চলে যেতেই বাংলায় লেখা ব্যানারটি সরিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

তবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে রাখার দুই সিটি করপোরেশনের কিছুটা টনক নড়েছিল। গত ২৮ জানুয়ারি ডিএনসিসি বিভিন্ন সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে বলা হয়েছিল, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরের সাত দিনের মধ্যে অন্য ভাষায় লেখা নামফলক, সাইনবোর্ড, ব্যানার বাংলায় প্রতিস্থাপন করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) অন্য ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড প্রতিস্থাপনের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি সাইনবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লেখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠিও দেওয়া হয়। সাইনবোর্ড বাংলায় না লেখায় দুই সিটি করপোরেশন ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। তখন অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের ওপরে ব্যানার টানিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাস চলে যেতেই পুরোনো রূপে ফিরেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড।

শিক্ষা, জীবিকার ভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা সমাজের সর্বস্তরে। এ অবস্থা বদলাতে হলে শিক্ষিত শ্রেণি এবং সরকারকে আন্তরিকভাবে বাংলা চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে।