গণতন্ত্রের জন্য ভীরু গণমাধ্যম কাম্য নয়

দেশ-বিদেশের সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল এবং কূটনীতিকদের দাবি এবং অনুরোধ উপেক্ষা করেই বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হলো। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সম্পাদক পরিষদের কাছে তাঁদের উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য তিনজন মন্ত্রীর আশ্বাসে যে ক্ষীণ আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তা মরীচিকার মতোই মিলিয়ে গেল। উদ্বেগ বিবেচনার আশ্বাস যে শুধু কথার কথা ছিল না, সে কথা এখন ওই মন্ত্রীরা বলতে পারবেন কি?

গত সোমবার রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর করেছেন। তবে মনে রাখা ভালো, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের বিষয়টি ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। আমাদের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যদি ১৫ দিনের মধ্যে তাঁর উদ্বেগ বা আপত্তির কথা জানিয়ে বিলটি সংসদে ফেরত পাঠাতেন, কেবল তাহলেই তা আইনে পরিণত হওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রশ্ন উঠত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সেই অবকাশ পেয়েছেন কি না, সে কথাও বিবেচনায় রাখা দরকার। সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে তিন মন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠানের পরপরই প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক উপদেষ্টার বক্তব্যে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন না পেলে কার্যকর বিরোধী দলবিহীন কোনো সংসদে যেকোনো আইন পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা নেই, সে কথা কারও অজানা নয়। তা ছাড়া বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের জন্য বিব্রতকর হয়, এমন কোনো পদক্ষেপের পরিণতি কি হয়, তা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জানেন না এমনও নয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো করুণ পরিস্থিতির শিকার কেই–বা হতে চায়?

প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় তাহলে সম্পাদকেরা কীভাবে ভরসা রাখতে পারলেন? প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরলে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে না হলেও দ্বিতীয় বৈঠকে সম্পাদকদের উদ্বেগগুলো তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছিলেন মন্ত্রীরা। সাইবার জগৎ যে দপ্তরের বিষয় সেই তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, আইনটির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য যারা—সেই গণমাধ্যম যার এখতিয়ারভুক্ত সেই তথ্য মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা যখন একসঙ্গে কোনো আশ্বাস দেন, তখন সম্পাদকেরা দায়িত্বশীলতার প্রকাশ ঘটাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্ত্রিসভার পরপর দুটো বৈঠকেও যখন মন্ত্রীরা প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে পারেন না এবং অন্যান্য আলোচ্যসূচির অজুহাত দেন, তখন তা পরিপূরক দায়িত্বশীলতা প্রমাণ করে না।

সোমবারের বৈঠকে অনেক ‘আইন ও আলোচ্যসূচি ছিল, যে কারণে এটা ওঠানো যায়নি’ এই বক্তব্যকে সম্ভাব্য দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথমত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা যে অবস্থান তুলে ধরেছেন, তা থেকে সরকার কোনোভাবেই সরে আসবে না, কোনো ছাড় দেবে না। অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জন্য যে বাড়তি সমস্যা তৈরি করছে, তার স্বীকারোক্তিতেই এর প্রমাণ মেলে। সে কারণেই আমরা শুনেছি ‘যারা উদ্বিগ্ন হয়ে আছে, তারা একটার পর একটা লেখা আমার ওপর চালাবে, আমার দলের বিরুদ্ধে—আমার বিরুদ্ধে চালাবে, তারা উদ্বিগ্ন হতে পারে। আপনাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিচ্ছু নেই।’

দ্বিতীয়ত, সম্পাদক পরিষদ এবং গণমাধ্যমের উদ্বেগ যে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই, এটা বুঝিয়ে দেওয়া। গণমাধ্যমে ভুলভ্রান্তির বিষয় স্বীকার করে নিয়ে দুঃখপ্রকাশকে যথেষ্ট হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের ভার আদালতের হাতেই’ তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্পষ্টতই স্বাধীন গণমাধ্যমকে চাপের মুখে রাখতে ভয় দেখানোই এর উদ্দেশ্য। গত দশ বছরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যে গণমাধ্যমে এক নজিরবিহীন মাত্রায় পরিবর্তন এনেছে, তা অনস্বীকার্য। ফলে গণমাধ্যমে রাজনৈতিক আনুগত্যের নিগড়েও অনেকে বাঁধা পড়েছেন, আর তা সাংবাদিকদের মধ্যে দলীয় বিভাজনকে তীব্র করেছে। সরকার এটিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে উৎসাহিত হচ্ছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের আপত্তি আইনটির নিবর্তনমূলক বিধানগুলোর বিষয়ে। তাঁদের মতে, এটি হচ্ছে সমসাময়িককালের সবচেয়ে নিবর্তনমূলক আইন। সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যে বৈশ্বিক সংগঠন, সেই কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বিলটিতে সই না করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যে অনুরোধ জানিয়েছিল, তাতে তারা লিখেছিল, ‘এই আইনের ফলে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় পরিণত হবে, যা অগ্রহণযোগ্য। এর পরিণতি হবে একটা ভীরু গণমাধ্যম, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতেরাও তাঁদের বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘এই আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো বাক্স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার পদ্ধতিগত নিশ্চয়তাকেও ক্ষুণ্ন করবে। বর্তমান অবস্থায় আইনটি এসব স্বাধীনতার প্রয়োগকে অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশ এখন এই নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি।

সরকার বলেছে যে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার জগতে নিরাপত্তার প্রশ্নটি জরুরি হয়ে পড়েছে এবং সে কারণেই এই আইন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো এবং বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটু বেশি এগিয়ে আছে, সে কথাও সরকার স্বীকার করে নিয়েছে। এর মানে হচ্ছে, অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য তারা অপেক্ষার ধার ধারেনি।

আসন্ন নির্বাচন  যে এই তাড়াহুড়ার একটা কারণ, তা কারওই বুঝতে বাকি নেই। তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়কমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচনের আগে অপপ্রচার বন্ধের জন্য এই আইন প্রয়োজন।

এই আইনের প্রথম খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয় চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি। তখন থেকেই এর নিবর্তনমূলক বিধানগুলো নিয়ে জোর আপত্তি উঠেছে। কথিত আক্রমণাত্মক এবং ভীতি প্রদর্শক তথ্য প্রকাশ, মানহানি এবং ধর্ম অবমাননার বিষয়গুলোর সংজ্ঞায়নের অস্পষ্টতা এবং অপব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগের আশঙ্কা নিয়ে যখন সবাই আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন, তখন হঠাৎ করেই তাতে যুক্ত হয়েছে পুলিশের সীমাহীন ক্ষমতা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর পাস হওয়া বিলটিতে কার্যত পুলিশকে যেসব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা একমাত্র কর্তৃত্বপরায়ণ ও পুলিশি রাষ্ট্রেই দেখা যায়।

আইনটি কার্যকর করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারির জন্য তড়িঘড়ি করে সরকার গুজব মনিটরিং সেলও প্রতিষ্ঠা করছে। তার চেয়েও বিপজ্জনক হলো, সরকার–সমর্থক ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের অনলাইনে নজরদারির উদ্যোগ। রাস্তার আন্দোলন দমনে যেভাবে পুলিশের পাশাপাশি হেলমেটধারী সরকার–সমর্থক পেটোয়া বাহিনীকে সক্রিয় দেখা দেখা গেছে, সে রকমই তৎপর হয়ে উঠেছে সাইবার যোদ্ধারা। এ ধরনের সাইবার যোদ্ধার আক্রমণের শিকার হয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলামকে কারাগারে যেতে হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শুধু গণমাধ্যমের ওপরে নয়, নাগরিকদের সংবিধান–প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতার ওপরেও খড়্গ নেমে এসেছে। সুতরাং এই আইনের বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া জরুরি। সম্পাদক পরিষদকে এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সাংবাদিকেরা অতীতে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছিল। নতুন এই বাস্তবতায়ও আমরা সাংবাদিক–সমাজের কাছে সাহসী ভূমিকা প্রত্যাশা করি।