রায়ে নৈতিক বিজয় দেখছে আ.লীগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ফাইল ছবি
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ফাইল ছবি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায়কে একটি ‘নৈতিক বিজয়’ বলে মনে করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। তারা মনে করে, ওই হামলার লক্ষ ছিল দলটির অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেওয়া। তার বিচার হয়েছে। রায় নিয়ে ‘দৃশ্যত’ খানিকটা উষ্মা দলের তরফে প্রকাশ করা হলেও শাসক দল মনে করছে, শুধু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নয়, আইনের শাসন প্রশ্নে সরকারের ভাবমূর্তিও এতে উজ্জ্বল হবে। তাদের ধারণা, এই রায়ের ফলে আওয়ামী লীগকে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য বিএনপির  যে অংশ তৎপর থেকেছে সবসময়, তারা এখন সংকটে পড়বে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য, দুই সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এই ধারণা পাওয়া গেছে। এই পাঁচজনের মধ্যে দুজন বাদে কেউ নাম প্রকাশ করতে চান নি।

আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও বলছেন, এর বিচার সংঘটন করা শুধু দল হিসেবে নয়, এই সরকারেরও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। আগামী ভোটে এর সুফল আওয়ামী লীগ কতটুকু পাবে তা সময়সাপেক্ষ। তবে আওয়ামী বিরোধী মহলের উদার অংশ বিএনপিকে বেছে নিতে সমস্যায় পড়বে। 

বিশ্লেষকদের ধারণা, এই ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হতে পারে। আর এই রায়ের ফলে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার চলমান প্রচেষ্টা প্রশ্নের মুখে পড়বে।

আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট চালানো গ্রেনেড হামলা মামলার গতকাল বুধবার দেওয়া রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ -এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন এই রায় দেন। এর মধ্য দিয়ে ১৪ বছর আগে সংঘটিত নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিচার বিচারিক আদালতে শেষ হলো। শেষ হলো দীর্ঘ অপেক্ষারও।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। এতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী সে সময়ের মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ জন মারা যান। আহত হন কয়েক শ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তবে তাঁর কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই রায়ের পর মামলার রায়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিক্রিয়া দেন। তিনি তারেক রহমানকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর ফাঁসির দাবি জানান। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমরা তারেক রহমানের ফাঁসি দাবি করছি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফাঁসি দাবি করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে সরকারের কাছে আবেদন করব।’

কাদের বলেন, ‘এই রায়ে আমরা আদালতকে ধন্যবাদ জানাই, অন্তত একটা বিচার তো হয়েছে। কিন্তু আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি।’

আর ২১ আগস্টের রায়কে ‘ফরমায়েশি’ ও ‘প্রতিহিংসার’ রায় উল্লেখ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় প্রত্যাখ্যান করেছ বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গতকালই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রায় প্রত্যাখ্যান করার কথা জানান।

এ রায়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এর ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো। শুধু আওয়ামী লীগের ওপর এই হামলা হয়নি। এর ফলে একটি গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। আর এর বিচার হওয়ার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পরাজয় হলো।’

আবদুর রাজ্জাক মনে করেন এর ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং এই ২১ আগস্টের বিচার—এর কোনোটিই বিশেষ কোনো ট্রাইব্যুনালে করেন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রচলিত আইন মেনে, যথাযথ প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করে বিচার করেছে। তাই এখানে কোনো ব্যত্যয় হয়েছে সেই প্রশ্ন তোলা অসম্ভব হবে। আর এর ফলে সংগত কারণেই সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য ও এক কেন্দ্রীয় সদস্য মনে করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২১ আগস্টের হামলাসহ বিভিন্ন সময়ে যে বৈরী আচরণ করা হয়েছে তা মূলে ছিল খালেদা জিয়ার পরিবার। বিএনপির অনেক সহানুভূতিশীল মানুষও ২১ আগস্টের হামলাকে সমর্থন করে না। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে কিন্তু তাঁকে হত্যা করতে হবে এমন মনোভাব তাদের নেই। কিন্তু দলীয় অবস্থানের কারণে তারা কোনো কিছু বলতে পারে না। বিএনপিতে যারা এসব বিষয় সমর্থন করে না তাদের এখন কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তারেক রহমানের অনুপস্থিতির এই সুযোগ তারা কাজে লাগাতে পারে। তারা অপরাধীমুক্ত একটি দল গঠন করতে পারে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই রায়ের আমাদের এক নৈতিক বিজয়। আইনের শাসনেরও বিজয়। যারা আইনের শাসন নেই বলে চিৎকার করেন তাদের দিকে এ রায় প্রশ্ন ছুড়ে দেবে।’

মহিবুল হাসান বলেন, বিএনপির ভেতরে যারা সজ্জন ব্যক্তি আছেন তারা নিশ্চয়ই চাইবেন না একজন খুনি তাদের দলীয় প্রধান হিসেবে থাকুক। তাদের দায়িত্ব আছে, দলকে কলঙ্কমুক্ত করা। আর তারা যদি তা না করে, তবে তাদের এ জন্য মূল্য দিতে হবে। বৈরিতার রাজনীতি বেশিদিন টেকে না, এ বিশ্বাস এখন তাদের করা উচিত।’

তবে এই রায়ের ফলে বিএনপির নেতৃত্ব এখনকার দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে দেবে, এমনটা মনে করেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার। আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় নিয়ে লন্ডনে পিএইচডি করা এই শিক্ষক মনে করেন, এই রায় আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই রায়ের সঙ্গে দলটির আবেগের বিষয় জড়িত ছিল। তবে শুধু তাই নয়, এর একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে।

শান্তনু মজুমদার বলেন, ২১ আগস্ট শুধু আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা নয়। এটা উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের চরমতম প্রকাশ। দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ছিল এ লক্ষ্য। আর সেদিন শেখ হাসিনা নিহত হলে আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকত।
অধ্যাপক মজুমদার মনে করেন, তাৎপর্যপূর্ণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা হয়তো সম্ভব হতো না কিন্তু দলটি বড় ধাক্কা খেত।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করে এই রায়ের ফলে চলমান ঐক্য প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়বে। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এই প্রক্রিয়ার কর্ণধার। তাদের একাধিক সমাবেশে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বিএনপির শীর্ষ নেতারা এসেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ২১ আগস্টের খুনের দায়ে দণ্ডিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরী কোনো নৈতিকতায় ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন? রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সড়ক পরিবহন অধিদপ্তরের এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ মন্তব্য করেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, আজকে যাঁরা গণতন্ত্রের ভাষায় কথা বলেন, যাঁরা আইনের শাসনের কথা বলেন, কথায় কথায় নৈতিকতার কথা বলেন, খুনিদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য করবেন, এই জাতীয় ঐক্যে জনগণ কোনো দিনও বিশ্বাস করবে না, সমর্থন করবে না। তিনি আরও বলেন, ‘২১ আগস্টের খুনিরা, মাস্টারমাইন্ড-প্ল্যানার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। তিনি (তারেক রহমান) যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সেই দলের সঙ্গে কোনো নৈতিকতায় ঐক্য করেন? এই খুনি দলের সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ও সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী আপনারা তথাকথিত জাতীয় ঐক্য করছেন?’

শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ঐক্য প্রক্রিয়ায় পুরোধা ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের উদার গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির প্রতীক। এই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য যারা আছে তাদের জন্য অসুবিধা না হলেও অন্তত কামাল হোসেনের জন্য অসুবিধা হবে খুনের জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির দলের সঙ্গে একযোগে কাজ করা।