সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ করবে কে?

দেয়ালে ফাটল, জন্মেছে লতা গুল্ম। বর্তমানে এই অবস্থা ঢাকা গেটের। গত বুধবার তোলা ছবি। আবদুস সালাম
দেয়ালে ফাটল, জন্মেছে লতা গুল্ম। বর্তমানে এই অবস্থা ঢাকা গেটের। গত বুধবার তোলা ছবি। আবদুস সালাম

গেটের দেয়ালে ফাটল তৈরি হয়েছে। সেখানে জন্মেছে লতাগুল্ম। আর গেটের চারপাশে ফেলে রাখা হয়েছে আবর্জনা। সেখানে মলমূত্রও ত্যাগ করে লোকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ঢাকা গেটের চিত্র এটি। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনা রক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান।

২০১৭ সালে ঢাকা গেটসহ ৭৫টি স্থাপনাকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকাভুক্ত করে রাজউক। ওই পরিপত্রে বলা হয়, ‘নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমতি ছাড়া এই স্থাপনাগুলোর কাঠামো আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজউকের তালিকায় থাকলেও দায়িত্বের আওতাভুক্ত হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এটির রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বলছে, স্থাপনাটি তাদের তালিকায় নেই। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হওয়ায় এটির দেখভালের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, গেটের সংস্কার করতে গেলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের আপত্তি ওঠে।

গত বুধবার দেখা যায়, হলুদ রঙের ঢাকা গেটের ওপর শেওলা জমেছে। সড়কের আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে গেটের চারপাশে। গেটের তিনটি অংশের একটি পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, মাঝখানের অংশ সড়ক বিভাজকের ওপর এবং অপর অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে তিন নেতার মাজারের পাশে। মাঝের অংশ ঢাকা পড়েছে গাছের আড়ালে। আর দুই পাশের অংশ পরিণত হয়েছে পথচারীদের মলমূত্র ত্যাগের স্থান ও ভাগাড়ে।

এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকা কোষ গ্রন্থে বলা হয়, মোগল আমলে ঢাকাকে স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এটি নির্মাণ করা হয়। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে তখনকার বাংলার সুবাদার মীর জুমলা এটি নির্মাণ করেন। ইতিহাসের পাতায় গেটটি মীর জুমলার গেট নামেও পরিচিত।

গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুক ছোট বোন শায়লা শারমীনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন বড় বোন সায়মা আক্তার। হেঁটে দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় ছোট বোনকে ঢাকা গেট দেখানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঢাকার ঐতিহাসিক এ স্থাপনা দেখার বদলে দুর্গন্ধের কারণে নাক ঢেকে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন তাঁরা।

>১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে তখনকার বাংলার সুবাদার মীর জুমলা এই গেট নির্মাণ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে সায়মা বলছিলেন, ‘শহর হিসেবে ঢাকা যে কতটা বাজে অবস্থায় পৌঁছেছে, সেটি ঢাকার এই ঐতিহাসিক স্থাপনার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ঢাকার নান্দনিকতা তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। নান্দনিকতার নিদর্শন হিসেবে যা আছে সেগুলোর ওপর বর্তমান ঢাকার চিত্রের ছাপ পড়ছে। ছয় বছর ধরে গেটটির একই অবস্থা দেখছি। ঢাকার ইতিহাস ঢাকা পড়ছে আবর্জনার আড়ালে।’

গেটটির বর্তমান অবস্থার কথা জানালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, ‘স্থাপনাটি এখনো অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হয়নি। আর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হওয়ায় আমরাও এটির সংস্কারে হাত দিতে পারছি না।’

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শতবর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন কমিটির সভায় ঢাকা গেট নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরিন আহমাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গেটের সংস্কার করতে গেলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের আপত্তি ওঠে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দেওয়ার আগেই আমাদের চেষ্টা থাকবে স্থাপনাগুলোর মর্যাদা ফিরিয়ে আনা। ঢাকা গেটসহ আরও কিছু স্থাপনা সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দের আলোচনা চলছে।’