আমি কি তোমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে পারি?

অদম্য মেধাবী মাহফুজার সঙ্গে লেখক। ছবি: প্রথম আলো
অদম্য মেধাবী মাহফুজার সঙ্গে লেখক। ছবি: প্রথম আলো

১৪ অক্টোবর, ২০১৭। ঢাকার কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয় যে ভবনে, সেটির নবমতলায় একটি মিলনায়তন আছে। সেখানেই একটি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছি সকাল থেকে। অনুষ্ঠানটি প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলোর মতো নয়। এ অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে ‘অদম্য মেধাবীদের’। প্রথম আলো ট্রাস্ট এক দশক ধরে এ কাজটি করছে। আমিও প্রতিবছর একঝাঁক মেধাবীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ নেওয়ার জন্য সেখানে গিয়ে বসে থাকি।
আমার বসে থাকার আরও একটি কারণও আছে। এই কার্যক্রমের সঙ্গে শুরুতে যুক্ত থাকার একটা সুযোগ আমার হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে প্রথম আলো। সে সময় আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। আমার অবসরের সব সময় কাটে প্রথম আলোতে, বিজ্ঞান প্রজন্ম নামে একটি সাপ্তাহিক ফিচার পাতা সম্পাদনা করে। সে সময় মতি ভাইসহ (মতিউর রহমান, প্রথম আলো সম্পাদক) একদল কর্মোদ্যোগী এক নতুন পথের সন্ধানে কাজ করে চলেছেন। আমরা সবাই তখন নিত্যনতুন চিন্তা, ভাবনা, পরিকল্পনা নিয়ে নিয়ত ভেবে যাচ্ছি।
১৯৯৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ যেদিন হয়, সেদিন আমরা সবাই পত্রিকা অফিসেই ছিলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যেতে যেতে আমার মনে হলো একসময় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকার সংবর্ধনা দিত, এখন আর দেয় না। বাসায় ফিরে গিয়ে জানলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবছর হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে আসেন, তাদের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটান। আমাদের মেধাবীরা সে সুযোগ পায় না। এই ভাবনা থেকে মতি ভাইকে ফোন করে জানালাম বিভিন্ন বোর্ডের এসএসসির মেধাতালিকায় (তখনো জিপিএ পদ্ধতি চালু হয়নি) প্রথম দিককার সবাইকে আমরা প্রথম আলো থেকে সংবর্ধনা দিই না কেন? মতি ভাই সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিলেন। পরদিন থেকে শুরু হলো এক নতুন আয়োজনের প্রস্তুতি, তবে সে অন্য গল্প। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে আমরা এক মেধাবীর খবর জানতে পারি। তার পক্ষে আমাদের সংবর্ধনায় আসার সামর্থ্যও ছিল না। সে অনুষ্ঠানে প্রথম আলো তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়, অনানুষ্ঠানিকভাবে। সেই ছেলেটি বর্তমানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে।
সেই থেকে প্রথম আলোর রিপোর্টাররা প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সেই সব মেধাবীকে খুঁজে বের করেন, যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সেরা সাফল্য দেখিয়েছে। প্রথম আলোতে সেই খবর ছাপা হতে শুরু করে ‘অদম্য মেধাবী’ শিরোনামে। সেই প্রতিবেদন পড়ে দেশ-বিদেশের অনেকেই তাদের পাশে দাঁড়াতে শুরু করেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট গঠনের পর এটি আনুষ্ঠানিক মাত্রা পায় এবং ২০১০ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংক যুক্ত হয়। তারপর থেকে প্রতিবছর ৫০ জন এসএসসি উত্তীর্ণ মেধাবী এই বৃত্তি কার্যক্রমে যুক্ত হয়, যারা সফলভাবে আগাতে পারলে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা পায়।
১৪ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে নতুন ৫০ জন, সঙ্গে ২০১৫ সালে যারা এই কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে যারা আবার জিপিএ–৫ পেয়েছে এবং যারা এবারের এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে, তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। মেডিকেলে সুযোগ পাওয়া তিনজনের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল।

এসএসসি পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৪ অক্টোবর ২০১৭। ছবি: প্রথম আলো
এসএসসি পরীক্ষায় অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীরা। সিএ ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৪ অক্টোবর ২০১৭। ছবি: প্রথম আলো

ওর কথা আমি আগে শুনেছি, কিন্তু দেখা হয়নি। মাহফুজা নামের এই মেয়েটি এসেছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার এক হতদরিদ্র পরিবার থেকে। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ার পর প্রথম আলোর সাংবাদিক শহীদ ভাই (শহীদুল ইসলাম) তাকে নিয়ে প্রথম আলোয় লেখেন। এরপর সে নির্বাচিত হয় অদম্য মেধাবীদের ৫০ জনের তালিকায়, ভর্তি হয় রংপুর কারমাইকেল কলেজে। পড়তে পারবে না ভেবে ডাক্তার হওয়ার যে ইচ্ছে কখনোই মুকুলিত হয়নি, সেটিই পত্রপল্লবে বিকশিত হয় প্রথম আলো-ব্র্যাক ব্যাংকের বৃত্তি পেয়ে। মনের গভীরে তখন থেকেই হাতছানি দিতে থাকে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। কাজেই এইচএসসি পরীক্ষা শেষে এডুকেশন ফর অল নামের একটি কার্যক্রমের খবর পায় সে প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদকের কাছ থেকে। সেই কার্যক্রমে নির্বাচিত হয়ে সে ঢাকায় আসে, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। তারপরের খবর আমরা জানি। মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ২৯০তম হয়ে মাহফুজা তার স্বপ্নের সিঁড়ির নাগাল পেয়ে যায়।
সংবর্ধনার মেডেল নিয়ে ও যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসে, তখনই আমি তাকে থামাই। তারপর সবিনয়ে বলি, ‘মাহফুজা, আমি কি তোমার সঙ্গে একটি সেলফি তুলতে পারি?’
অবাক মাহফুজা সলজ্জ হাসি দিয়ে আমার সঙ্গে ছবি তোলে। তারপর চলে যায় নিজের আসনে। আনন্দিত আমি ফোন বের করে আবার ওই ছবি দেখতে গিয়ে দেখি, ছবিটা ভালোমতো ওঠেনি!! এমনিতে আমি সেলফি তুলতে পারি না। তারপর মান্ধাতার আমলের ফোন। তো, কী করি?
অনুষ্ঠান শেষে মাহফুজাকে আবার খুঁজে বের করি। মিলনায়তনের শেষের দিকে মাহফুজা বসে আছে তার ভাইয়ের সঙ্গে। ভাইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রিকশা চালায়। ওর বাবা এখন আর কিছু করার সামর্থ্য রাখেন না। বাবা–মা থাকেন পঞ্চগড়ের সেই গ্রামে।
আমাকে দেখে মাহফুজা অবাক হয়। ওর বিস্মিত চোখের সামনে ডেকে আনি প্রথম আলোর আলোকচিত্রী সালামকে। সালামের ক্যামেরায় শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ছবিটি তুলেছি।
মাহফুজার মতো নতুন ৫০ জন আজ প্রথম আলো ট্রাস্ট্রের এই বৃত্তি কার্যক্রমে যুক্ত হবে। তারা আসবে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে। সেখানে আমরা শুনতে পাব আরও অনেক মাহফুজার গল্প। শ্রম, ঘাম আর মেধা দিয়ে তাদের দমে না যাওয়ার গল্প। তাদের স্বপ্নের গল্প। যে স্বপ্নপূরণের ধাপ সৃষ্টি করে চলেছে ব্র্যাক ব্যাংক আর প্রথম আলো।

আজ সকাল ১০টা থেকে শুরু হবে এই আয়োজন।