আ.লীগ ধর্মীয় দলের সঙ্গে বামদেরও চায়

>

• এক ডজনের বেশি দল-জোট নজরে আছে
• বামজোট ও ধর্মভিত্তিক কিছু দল নিয়ে বেশি আগ্রহ
• কয়েকটি ইসলামি দল-জোট আসতে প্রস্তুত
• বামপন্থী নতুন জোট এখনো রাজি হয়নি
• তফসিল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কিছু দল

বিরোধী রাজনৈতিক জোট ভোটে অংশগ্রহণ বা বর্জন; যা–ই করুক—পরিস্থিতি মোকাবিলায় অধিক নির্বাচনী মিত্রের খোঁজে আছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে তাদের চেষ্টার কেন্দ্রে আছে বামপন্থী দলগুলোর জোট এবং ধর্মভিত্তিক কিছু দল।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, ধর্মীয় কিছু দল ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আছে। আরও কয়েকটি আসার জন্য প্রস্তুত আছে। এখন ১৪-দলীয় জোটের বাইরে থাকা বামপন্থী দলগুলোকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা আছে। এ ছাড়া নাম বা নেতাসর্বস্ব কয়েকটি দলের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে। সব মিলিয়ে এক ডজনের বেশি দল ও জোট আওয়ামী লীগের নজরে আছে।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তাদের মিত্র এবং সম্ভাব্য মিত্রদের মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক. ১৪-দলীয় জোটসহ কিছু দল আছে, যারা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি জোটে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। দুই. কিছু নতুন দল ও জোট যাদের আওয়ামী লীগ চায়। কিন্তু তারা এখনো কথা দেয়নি। তিন. কিছু আছে, যাদের খুব একটা প্রভাব নেই। তবে সঙ্গে থাকলে সংখ্যা বাড়ে। এসব দল বা জোট নিজেরাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার জন্য আগ্রহ দেখিয়ে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করছে।

১৪-দলীয় জোটের সম্প্রসারণ হোক, সেটা চায় না শরিকেরা। ফলে এ জোট না বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে। তবে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, বামপন্থী কোনো দল বা জোট আসতে রাজি হলে তাদের ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা আছে। এ ব্যাপারে জোটের অন্য শরিকদের আপত্তি থাকবে না। তবে ধর্মভিত্তিক কোনো দলকে ১৪ দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না শরিকেরা। তাই তাদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য হতে পারে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করা হবে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী যে কেউ মিত্র হতে পারে। অনেকে যোগাযোগ করছে। তবে তফসিল ঘোষণার পর জোট-মহাজোট চূড়ান্ত হবে।

বামপন্থী আটটি বাম দল গত এপ্রিলে বাম গণতান্ত্রিক জোট নামে নতুন জোট করে। এতে যুক্ত দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। এরপর গত জুলাইয়ে হঠাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সিপিবি কার্যালয়ে গিয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এখনো ওই জোটের কারও কারও সঙ্গে সরকারি কোনো কোনো মহলেরও যোগাযোগ আছে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, যদি বাম জোট সরকারি দলের সঙ্গে ঐক্য না করতে চায়, সে ক্ষেত্রে তারা যাতে বিরোধী কোনো জোটে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই জোটেরই বিরোধী তাঁরা। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-আওয়ামী লীগ জোট নিজেদের লুটেরা চরিত্র পাল্টালে আমাদের সঙ্গে তারা আসতে পারে। তবে তারা বদলাতে পারবে বলে মনে হয় না।’

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বামপন্থীদের বাইরে আওয়ামী লীগ বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রয়াত মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট, আটরশি পীরের দল জাকের পার্টি ও বিএনপি জোটে থাকা অলি আহমদের দল এলডিপি। হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও তাদেরও পাশে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ। অবশ্য হেফাজতের নেতাদের একটা অংশের সঙ্গে সরকা​রি মহলের ভালো যোগাযোগ আছে। এর বাইরে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বা তাদের জোট যুক্তফ্রন্ট নিয়েও সরকারি দলের পরিকল্পনা আছে।

এসব দলের কারও কারও সঙ্গে সরকারি কোনো কোনো মহলের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। তবে কে কত আসন পাবে, সরকারে গেলে কার কী অবস্থান হবে—এসব বিষয়ে এখনো ফয়সালা হয়নি। তফসিল ঘোষণা হলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে জানা গেছে।

এর মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলে ছিল। ​২০১৬ সালে ওই জোট ছাড়ে তারা। দলটির চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি জোটসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকেই যোগাযোগ করছে। চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন সব দল ও জোটে ঝামেলা আছে। এক পক্ষ সরকারের দিকে আসতে চায়, আরেক পক্ষ চায় না। কেউ কেউ মনে করছে, এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে দর-কষাকষিতে পিছিয়ে যেতে হবে। ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণ পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছে সবাই।

এ ছাড়া যেসব দল আসতে চায় এবং যাদের আনতে চায়, তাদের সরাসরি নিজেদের জোটে আনা হবে, নাকি পরোক্ষভাবে সরকারের সঙ্গে থাকা অন্য কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেটা এখনো চূড়ান্ত করেনি আওয়ামী লীগ। তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্মকৌশল দেখে এ বিষয়গুলো ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে। 

সঙ্গে থাকতে চায় যারা
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর ১৫টি দলের সমন্বয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স গঠন করা হয়েছে। এর নেতৃত্বে মিছবাহুর রহমান ও এম এ আউয়াল। বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে ছিলেন। এম এ আউয়াল ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব। এই জোটের আত্মপ্রকাশের পেছনেই আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। অবশ্য এই জোটের কোনো দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই।

সৈয়দ বাহাদুর শাহর ইসলামিক ফ্রন্ট, আলমগীর মজুমদারের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদার বিএনএ জোট নিজেরাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। এদের মধ্যে কেবল ইসলামিক ফ্রন্টের নিবন্ধন আছে।

২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনএফের নিবন্ধন পাওয়া, পরে এর প্রধান আবুল কালাম আজাদের ঢাকা-১৭ আসন থেকে জয়ী হওয়ার বিষয়টি গত নির্বাচনের আলোচিত ঘটনা। সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দলটির এই উত্থান। এরা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চায়।

কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গত নির্বাচন বর্জন করে। সরকারবিরোধী অবস্থানও নিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নীলুর এনপিপিও সরকারি জোটে থাকবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন।

সম্প্রতি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ইতিমধ্যে বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে ​দেখা করেছেন। তবে তাঁদের লক্ষ্য ক্ষমতাসীন জোটে যাওয়া। এর মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাপের সভাপতি জেবেল রহমান গানি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়নি। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, যেসব দলের সঙ্গে আলাপ চলছে, তাদের কেউ কেউ আসন সমঝোতা চায়, কেউ কেউ মন্ত্রিত্বের আশ্বাস চায়; আবার কেউ কেউ আর্থিক সুবিধা চায়। তবে আওয়ামী লীগের বড় মূল লক্ষ্য সিপিবির নেতৃত্বাধীন ৮-দলীয় বাম জোট। হেফাজতে ইসলামকেও পাশে পেতে চাইছে। আর যতটা সম্ভব বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে ভাঙন ধরানোও বড় লক্ষ্য। এই নেতার মতে, ভোটের বিবেচনায় এসব দলের কোনো প্রভাব না থাকলেও এটা বিরোধী পক্ষের সঙ্গে একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।

এই বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘোষিত আদর্শ যা-ই থাকুক না কেন, ক্ষমতার জন্য সবই করেছে তারা। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ফলে ধর্মভিত্তিক দলকে মিত্র বানানো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁর মতে, এবারের নির্বাচনটা বেশ জটিল। বিরোধীরা ভোটে অংশগ্রহণ বা বর্জন; যা-ই করুক ক্ষমতাসীনদের দল ভারী করার প্রয়োজন আছে।