বাক্স্বাধীনতার সংকট বিশ্বজুড়ে

ফিতা কেটে সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও অতিথিরা। গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে।  ছবি: প্রথম আলো
ফিতা কেটে সাহিত্য উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও অতিথিরা। গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। ছবি: প্রথম আলো

পোশাকি নাম ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। সোজা বাংলায় ঢাকা সাহিত্য উৎসব। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার হেমন্তের সকালে বাংলা একাডেমিতে শুরু হওয়া উৎসবটি শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশ-বিদেশের গুণীজনদের আলোচনা, আড্ডা, গান, নাচ, চলচ্চিত্র, বই নিয়ে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক উৎসবে রূপ নেয় আয়োজনটি। আর এই উৎসবের উদ্বোধনীতে উচ্চকণ্ঠে একটি শব্দ বারবার উচ্চারিত হয়েছে—বাক্‌স্বাধীনতা! সম্প্রতি বাংলাদেশে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বাক্স্বাধীনতার প্রশ্নে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ দেশের গুণীজনেরা। অন্য দেশের বক্তারা বললেন, বাক্‌স্বাধীনতা শুধু একটি দেশের বিষয় নয়, এ সংকট বিশ্বজুড়েই।

সকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ফিতা কেটে উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সঙ্গে ছিলেন বলিউড অভিনেত্রী ও নির্মাতা নন্দিতা দাস, পুলিৎজার বিজয়ী লেখক অ্যাডাম জনসন এবং উৎসবের তিন পরিচালক।

নানা দিকে বিভিন্ন আকৃতির স্টল, প্যাভিলিয়নে ছিল উৎসবের আমেজ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় কত্থক নৃত্যের মধ্য দিয়ে। পরিবেশন করেন মুনমুন আহমেদ ও রেওয়াজ পারফর্মিং আর্টের শিল্পীরা।

উদ্বোধনী বক্তৃতায় আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘এই উৎসব ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। একই সঙ্গে পরিচিতি ঘটছে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক, চলচ্চিত্রসহ আমাদের নানা ঐতিহ্যের। বরেণ্য লেখকেরা যোগ দিয়ে উৎসব সফল করে তুলছেন।’

নন্দিতা দাস বলেন, বাক্স্বাধীনতা প্রকাশের প্রধান হাতিয়ার সাহিত্য। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে কোনো না কোনোভাবে বাক্স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম কারাগারে বন্দী থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে নন্দিতা দাস বলেন, ‘তাঁর জন্য আমাদের সবার একসঙ্গে আওয়াজ তোলা উচিত।’

বাংলাদেশে সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে বাক্স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা করা হচ্ছে, এমন মন্তব্য করে উৎসবের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ বলেন, ‘এ উৎসব সব সময় মুক্তচিন্তা ও বাক্স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এখানে কেউ কথা বলতে বাধার সম্মুখীন হয় না।’ পুলিৎজার বিজয়ী লেখক অ্যাডাম জনসন বলেন, ‘বিশ্বমানবতার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এখন লেখকেরা কথা বলছেন। এই উৎসবে মুক্তভাবে নিজেদের ভাবনা ও কথা তুলে ধরতে পারব জেনে ভালো লাগছে।’ উৎসবের পরিচালক আহসান আকবার বলেন, ‘বাংলাদেশকে বিশ্বসাহিত্যের বাজারে নিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য।’ উৎসবের অপর পরিচালক সাদাফ সায্ বলেন, ‘আমরা যা বলতে চাই, তা বলে যাওয়া উচিত।’

আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর বাংলা একাডেমি চত্বরে বিভিন্ন মঞ্চে বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা ও আড্ডা জমে ওঠে। কাজী আনিস আহমেদের সঞ্চালনায় ‘পোস্ট-আমেরিকা ফিউচার’ আসরে কথা বলেন অ্যাডাম জনসন, ডেভিড বিয়েলো, জেমস মিক, কোর্টনি হোডেল ও নিশিদ হাজারির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরা। ‘প্রকাশনাশিল্প ও বইয়ের বিপণন’ শীর্ষক আলোচনায় যোগ দেন প্রকাশক খান মাহাবুব, মিলন কান্তি নাথ, সৈয়দ জাকির হোসাইন, মাহরুখ মহিউদ্দীন এবং পশ্চিমবঙ্গের দে’জ পাবলিশিংয়ের প্রকাশক অপু দে। এ আলোচনায় উঠে আসে প্রকাশনাশিল্পের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ।

যুদ্ধ এখন যেন সারা পৃথিবীর বাস্তবতা। এই কঠিন বাস্তবতা নিয়ে ‘ক্র্যাশিং রিয়েলিটিস’ শিরোনামের আসরে মূল মঞ্চে কথা বলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক মোহাম্মদ হানিফ, সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ সাহিত্য ম্যাগাজিন গ্রান্টার নির্বাহী সম্পাদক রস পর্টার। ‘সময়ের গান, অসময়ের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।

‘যে গল্পের পাঠক নেই’ শীর্ষক আলোচনা হয় ছোটগল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে। কথা বলেন মঈনুল আহসান সাবের, আহমাদ মোস্তফা কামাল, হামীম কামরুল হক ও রাশিদা সুলতানা। সঞ্চালনা করেন পারভেজ হোসেন।

নভেরা প্রদর্শনী মিলনায়তনে গর্গ চ্যাটার্জির সঞ্চালনায় ‘রাইট টু লাই’ শীর্ষক আসরে কথা বলেন জাকির কিবরিয়া, সৈয়দ মফিজ কামাল অনিক ও ডেভিড বিওয়েল। তাঁরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও ব্যক্তি আচরণ নিয়ে কথা বলেন। প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষকে মিথ্যুক করে তুলছে। মানুষ কথা বলার সময় ও সুযোগ হারিয়ে ফেলছে—এমনটাই উঠে আসে আলোচনায়। প্রথম দিন আরও ছিল কবিতাপাঠসহ বেশ কয়েকটি আসর।