প্রশ্নবিদ্ধ উপমন্ত্রী ও তাঁর ভাই

>

*চাকরির জন্য টাকা আদায়ের অভিযোগ
*অভিযোগকারীদের মধ্যে আ.লীগ কর্মীরা
*টাকা দেওয়ার পরও চাকরি হয়নি
*খেলোয়াড়দের অনুদানের টাকাও নয়ছয়
*উপমন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
*ভাই বলেছেন, সব অভিযোগ মিথ্যা

চাকরি দেবেন বলে টাকা নিয়েছিলেন, এখন আর চিনতে পারছেন না। ফোন ধরছেন না। দেখাও দিচ্ছেন না। গুরুতর এই অভিযোগ যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের বিরুদ্ধে।

গত ৩০ অক্টোবর থেকে টানা তিন দিন আরিফ খানের নির্বাচনী এলাকা নেত্রকোনা সদর ও বারহাট্টার অন্তত ২৫ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। এই ২৫ জনের মধ্যে আছেন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এই অভিযোগের ব্যাপারে উপমন্ত্রী কী বলেন, তা জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অন্তত ১০ বার তাঁর মুঠোফোনে ফোন করা হয়। তিনি ধরেননি। তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। তবু তিনি সাড়া দেননি।

অভিযোগকারীরা বলেছেন, কলেজশিক্ষক, পুলিশ বা পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী পদে চাকরির জন্য তাঁরা সরাসরি কিংবা প্রতিনিধির মাধ্যমে টাকা দিয়েছেন আরিফ খান ও তাঁর বড় ভাই নূর খান মিঠুকে।

চাকরি দেওয়ার নাম করে আরিফ খান কিংবা তাঁর ভাই আসলে কী করেছেন? নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনুর রহমানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বারহাট্টা স্টেশন রোডে তাঁর এক কক্ষের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে। তাঁর দাবি, বছর তিনেক আগে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা পদে স্ত্রীর চাকরির জন্য তিনি উপমন্ত্রী আরিফ খানের প্রতিনিধি চন্দন সরকারের কাছে প্রথম দফায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দেন। পরে ব্যাংকে জমা দেন আরও ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। স্ত্রীর চাকরি হয়নি। টাকাও ফেরত পাননি। কথাবার্তার ফাঁকে তিনি চেকের কপিটি দেখান প্রথম আলোকে। এখন উপমন্ত্রী কী বলছেন জানতে চাইলে শাহীনুর বলেন, ‘মন্ত্রী সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও তিনি দেখা দেন না। অনেকবার চেষ্টার পর একবার ফোন ধরেছেন, বলেছেন “তোর টাকা অহনও পাস নাই। আচ্ছা দেখতাসি। ” এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই।’

শাহীনুরের সঙ্গে কথা বলার সময় একে একে সেখানে জড়ো হন অনেকেই। কেউ ভাই, কেউ ভাতিজা বা ভাগনের চাকরির জন্য টাকা দিয়েছেন। তাঁদের বড় অংশ দেড় লাখ করে টাকা দিয়েছিলেন ৩৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম দপ্তরির চাকরির জন্য। তাঁরা বলেন, বছর তিনেক আগে নৈশপ্রহরী কাম দপ্তরি নিয়োগের জন্য এলাকায় স্কুলপ্রতি ১০-১২ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে স্কুলপ্রতি তিনজন মনোনীত হন। এই তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে উপমন্ত্রীর অনানুষ্ঠানিক পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি দেওয়ার কথা। নিয়োগটি পরে স্থগিত হয়ে যায়। কারও চাকরি হয়নি। কেউ টাকাও ফেরত পাননি। এক স্কুলে মনোনীত তিন প্রার্থীর কাছ থেকেই আবারও টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে।

কড়ইতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নাজমুল হুদা জানান, তাঁর গ্রামের তিনটি ছেলেই টাকা দিয়েছেন, এ কথা তাঁরা নিজেরা এসে তাঁকে জানিয়েছেন।

মনকান্দিয়া গ্রামের হাবিব মিয়া বলেন, ‘আমনেরা একটু দেখুইন যে। আমি কর্ম করবার পারি না। বড় একটা ছেলে আছিন। তার লাইগা দিছিলাম ট্যাকা, জমি বন্ধক রাখিয়া। খুব কষ্ট করতাসি অহন।’

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দপ্তরি নিয়োগ বাবদ টাকা তুলেছেন শেখেরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামালউদ্দীন চাম্পা। তবে কামালউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি উপমন্ত্রী আরিফ খানের বন্ধু। এই নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় উপমন্ত্রীর প্রতিনিধি ছিলেন। তবে টাকাপয়সা ছুঁয়েও দেখেননি। সব মিথ্যা কথা।

চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে আরিফ খানের ভাই নূর খান মিঠুর বিরুদ্ধেও। স্থানীয় চন্দ্রনাথ কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালুর পর শিক্ষকপ্রতি তিনি কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। নেত্রকোনা জেলা পরিষদের একজন সদস্য পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে মিঠু ভাইয়ের চুক্তি ছিল ছয় লাখ টাকার। নিয়োগ শুরুর অনেক আগে চার লাখ টাকা একবারে দিসি। বাকিটা পরে দিব বলছিলাম। আরেকজন সাত লাখ দিয়া চাকরিটা নিয়া গেল।’ ওই ব্যক্তি আরও বলেন, কখনো ৫ হাজার, কখনো ১০ হাজার টাকা করে নূর খান মিঠু ৩ লাখ টাকা শোধ করেছেন। বাকি টাকার আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করেন নূর খান মিঠুও। গতকাল রোববার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এসব ডাহা মিথ্যা কথা। নির্বাচনে হারানোর জন্যই এসব কথা বলা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এত উদারভাবে আর কেউ মানুষের সেবা করেনি।’

বেপরোয়া উপমন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়েরা
২০১৪ সাল থেকে আরিফ খানের বিরুদ্ধে অন্তত ছয়টি ঘটনার কথা জানা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে খেলার মাঠে পিস্তল নিয়ে ঢুকে রেফারিকে শাসানো, যুব দিবসের অনুষ্ঠানের ব্যানারে নাম না থাকায় মন্ত্রণালয়ে ভাঙচুর, আশুলিয়ায় পুলিশের সহকারী পরিদর্শক মলয় কুমার সাহা ও কালিয়ারা গাবরাগাতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আমজাদ হোসেনকে পেটানো এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নিজের স্ত্রীকে সভাপতি না করায় ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করানোর অভিযোগ আছে। সবশেষ বিজয়া দশমীর রাতে নিউ টাউনে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক নীলম বিশ্বাস ও তাঁর বড় ভাই প্রীতম বিশ্বাসকে উপমন্ত্রী নিজেই পেটান বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। নিউ টাউনে আরিফ খানের পৈতৃক বাড়ি। এখানেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

উপমন্ত্রীর ভাইদের বিরুদ্ধে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগও আছে। প্রতিটি সংযোগে সাড়ে চার শ টাকা জামানত ছাড়া গ্রাহকদের আর কিছু দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু মিটারপ্রতি তাঁদের গড়ে চার হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন পরিচালক নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত যতগুলো বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়েছে, তার প্রতিটি থেকেই প্রতিনিধি মারফত টাকা নিয়েছেন আরিফ খান ও শামীম খান। এসব অভিযোগের ব্যাপারে নেত্রকোনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মজিবর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

খেলোয়াড়দের অনুদানের টাকাও নয়ছয়
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য খেলাধুলা পরিচালনা ও মাঠ সংস্কারের জন্য এবং প্রশংসাযোগ্য ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে সাবেক খেলোয়াড়দের অনুদানের টাকা বরাদ্দ করে সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটিকে। জানা গেছে, কমিটি যাঁদের নাম প্রস্তাব করেছিল, তালিকায় তাঁদের একজনেরও নাম নেই।

নেত্রকোনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক মুখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই টাকা ৪৪টি ক্লাব বা সংগঠনের কাছে গেছে। তার মধ্যে মাত্র একটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য। যে ৩১ জন দুস্থ খেলোয়াড় কাগজে-কলমে টাকা পেয়েছেন, তাঁদের একজনও খেলোয়াড় বা সংগঠক নন। তাঁদের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

জানতে চাইলে ওই কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা আবদুল বারি প্রথম আলোকে বলেন, কারা শেষ পর্যন্ত অনুদানের টাকা পেলেন, তিনি জানতে চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। উত্তর পাননি। আর জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম বলেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে ভালো জানেন না।