একটি ভিডিও এবং শিশু জারিফকে পাওয়ার গল্প

গত বৃহস্পতিবার নানা নাটকীয়তার পর উদ্ধার হওয়ার পর বাবা–মায়ের সঙ্গে শিশু জারিফ।   ছবি: সংগৃহীত
গত বৃহস্পতিবার নানা নাটকীয়তার পর উদ্ধার হওয়ার পর বাবা–মায়ের সঙ্গে শিশু জারিফ। ছবি: সংগৃহীত

মাত্র ৫১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। সেই ভিডিওতে এক অসহায় বাবার আর্তি—‘আপনারা জানেন আমার ছেলে জারিফ নিখোঁজ রয়েছে। আপনারা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালালে হয়তো আমার ছেলেকে ফিরে পাব। নিজের ছেলে মনে করে সবাই একটু আমার ছেলেকে খোঁজার জন্য বের হবেন।’ বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল বাবা মো. জ্যাকবের। কান্না আর ফোঁপানোর শব্দে অস্পষ্ট হয়ে উঠছিল কণ্ঠ।

গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফেসবুকে শেয়ার করা সেই ভিডিও মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর একযোগে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের হাজারো লোক নেমে পড়েন শিশুটির খোঁজে। তাঁদের সঙ্গে পুলিশ তো ছিলই। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয় জারিফ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিশুটিকে উদ্ধারের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে সবখানে। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন চার তরুণ।

গত মঙ্গলবার দুপুরে সন্দ্বীপের বাউরিয়া আইল্যান্ড কিন্ডারগার্টেনের সামনে থেকে মা পরিচয় দিয়ে জারিফকে স্কুলভ্যান থেকে নামিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যান এক নারী। জারিফ ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেজিতে পড়ে। পরে খবর পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ শুরু করেন তার বাবা। পুলিশকেও জানানো হয়। কোথাও না পেয়ে একটি ওয়াজ মাহফিলেও মাইকিং করা হয়। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।

জারিফ অপহরণ হওয়ার পর থেকেই তার বাবাকে এ ক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন এলাকার চার তরুণ—হান্নান তারেক, সজীব খান, জাহিদ হাসান ও ফিরোজ খান। তাঁরা সবাই বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

অপহরণের পরদিন বুধবার রাতের কোনো এক সময় জারিফের বাসার সামনে তার স্কুলড্রেস ও এর সঙ্গে একটা চিরকুট রেখে যায় কেউ একজন। সেই চিরকুটে লেখা ছিল—‘আজকের মধ্যে চার লাখ টাকা দিতে হবে। কাউকে জানানো হলে মেরে ফেলা হবে জারিফকে।’ একটি মুঠোফোন নম্বরও লেখা ছিল। মুঠোফোন নম্বরটি পেয়ে জারিফের বাবা ও তরুণেরা ভোরেই থানায় যান।

পরের গল্পটি শোনা যাক হান্নান তারেকের মুখ থেকেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোন নম্বরটি ট্র্যাক করার পর পুলিশ জানাল, সেই নম্বর ৯ দিন ধরে বন্ধ। এরপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রশাসনের পাশাপাশি তাঁরাও এই নম্বরের ক্লু ধরে এগোবেন। নম্বরটি মুঠোফোনে সেভ করার পর দেখা গেল, ইমোতে তাহমিনা নামের একটা আইডি শো করছে, সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ভাসছে। সেই ছবি জারিফের পরিবারের সবাইকে দেখানো হলো। কিন্তু কেউ চিনলেন না। এরপর চার তরুণ তাঁদের আরেক বন্ধুর সহায়তায় ওই নম্বর ব্যবহারকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ বের করেন। জাতীয় পরিচয়পত্রটি ছিল তাহমিনা নামের ওই নারীর। এরপর আরেকজনের সহায়তায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বের করা হলো তাহমিনার ঠিকানা। সেখানে দেখা যায়, তাহমিনার বাড়ি জারিফদের বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যেই। এরপর তাঁরা পুলিশকে জানান বিষয়টি।

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকেই শুরু হয় অভিযান। সাদাপোশাকে পুলিশের একটি দল ছিল তাহমিনার বাড়ির অদূরের নাজির হাট এলাকায়। বাড়ির আশপাশে অবস্থান করেন জারিফের বাবাসহ কয়েকজন। আর চার তরুণ যান তাহমিনার ঘরে। ঘরের সামনেই পাওয়া গেল তাহমিনাকে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ধরে ফেলেন তাঁরা। এরপর ঘরে ঢুকে দেখেন, কম্বলে মোড়ানো অবস্থায় খাটে ফেলে রাখা হয়েছে জারিফকে।

হান্নান তারেক বলেন, ‘জারিফকে কোলে নিয়েই আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি। এই কান্না ছিল আনন্দের, জারিফকে অক্ষত পাওয়ার।’

জারিফের বাবা মো. জ্যাকব ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই যেভাবে আমার ছেলেকে উদ্ধারে আবেগ দেখিয়েছেন, ভালোবাসা দেখিয়েছেন, সেটি সারা জীবন মনে থাকবে।’

এ ঘটনায় তাহমিনা, তাঁর স্বামী মো. দেলোয়ার হোসেনসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজাহান।