নিরাপদ শ্রম অভিবাসনের জন্য চাই রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার

প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘অভিবাসীর ইশতেহার: চাই নিরাপদ অভিবাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ২৫ নভেম্বর। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘অভিবাসীর ইশতেহার: চাই নিরাপদ অভিবাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ২৫ নভেম্বর। ছবি: প্রথম আলো

নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য রাজনীতিবিদদের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে সব রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে লড়বেন, নিরাপদ শ্রম অভিবাসনের জন্য তাদের অঙ্গীকার করতে হবে।

আজ রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘অভিবাসীর ইশতেহার: চাই নিরাপদ অভিবাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা এ কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বেসরকারি সংস্থা আইআইডি এ আয়োজনে সহায়তা করেছে। আলোচনায় সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম।

নারী সাংসদ ও অভিবাসন বিষয়ক সংসদীয় ককাসের অন্যতম সদস্য হোসনে আরা ডালিয়া লুৎফা বলেন, অভিবাসী বিষয়ক ইশতেহারের খসড়ায় যে সব প্রস্তাবের কথা এসেছে তা নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আছে। শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে যে সব সমস্যা রয়েছে তা সুরাহার জন্য প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে আগ্রহী লোকজনের পর্যাপ্ত তথ্য জানা দরকার। লোকজনের বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ স্তরে তথ্য ভান্ডার থাকা জরুরি। এ নিয়ে তথ্যের ক্ষেত্রে যে সব ঘাটতি আছে তা দূর করা দরকার।

ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ফর রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, অভিবাসীর ইশতেহারে রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলো থাকতে হবে। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে, সমঝোতা স্মারক নয়।

বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বোমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের নির্যাতনের হার কমেছে বলে সরকারের কর্মকর্তাদের মধ্যে আত্মতুষ্টি দেখা যায়। অথচ নারী কর্মীদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের ওপর সহিংসতা চালানো হয়।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়ে সব সময় অস্বীকারের সংস্কৃতি দৃশ্যমান। গত চার মাসে সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা অন্তত চার হাজার নারী কর্মীকে সহায়তা করেছে ব্র্যাক। এদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত নারী ছিলেন। এদের সুরক্ষার দায়িত্ব প্রথমত রাষ্ট্রের। তবে এদের কল্যাণে শেষ পর্যন্ত সবাইকে মিলেই কাজ করতে হবে।

আইআইডির প্রধান নির্বাহী সাঈদ আহমেদ বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে যে সব প্রার্থী মনোনয়ন পাবেন, নির্বাচিত হলে অভিবাসী শ্রমিকদের তারা কি করবেন, সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করতে হবে। এ জন্য অভিবাসীর ইশতেহার নিয়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে যাওয়া হবে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে—নারীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষাসহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন নিশ্চিত করা, নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগত করা, বাংলাদেশিদের নিরাপদে বিদেশে পাঠানো এবং ফিরিয়ে আনাসহ অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসকে কার্যকর ভূমিকা রাখা, অভিবাসীদের কল্যাণে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা, সব আইন ও নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা এবং নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা।

গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা আরও বলেন, পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় বাংলাদেশের বিদেশগামী কর্মীদের দালালের শরণাপন্ন হতে হয়। দালালদের দৌরাত্ম্যে পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তাই নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের স্বার্থে দালালদের দায়বদ্ধতায় আনা জরুরি।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রমোটিং নলেজ ফর অ্যাকাউন্টেবল সিস্টেমসের (প্রকাশ) জেন্ডার ও সোশাল ইনক্লুশন অ্যাডভাইজর শিরিন সুলতানা লিরা বলেন, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী রয়েছে। এদের আইনের আওতায় আনা যায়। এদের আইনগতভাবে দায়বদ্ধতার আওতায় আনা গেলে সমাধানের সুযোগ তৈরি হবে। তাঁর মতে, বিদেশে কাজ শেষে যে সব বাংলাদেশি ফিরবেন তাদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটিও ভাবা উচিত।

এ প্রসঙ্গে ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ফর রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় দালালদের কারণে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশের লোকজনকে বিদেশ যেতে হয়। কারণ এরা ভিসা কিনে ব্যবসা করে, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে ভিসার দাম বাড়ায়। এখানে সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সির তেমন কিছু করার নেই।

আইআইডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সানজিদা রহমান বলেন, বিদেশি যে সব কর্মী যান তাদের কাছে যথাযথ তথ্য না থাকায় দালালদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। বেশ কয়েকটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কোন দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। বিদেশ পাড়ি দেওয়ার তিন দিন আগে ওইসব কেন্দ্র থেকে একটি সনদ নিয়ে লোকজন বিদেশ পাড়ি জমায়। অথচ দক্ষ কর্মী পাঠানো হলে রেমিট্যান্স দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

রিফিউজিস অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রধান মেরিনা সুলতানা বলেন, বিদেশ থেকে ফেরার পর লোকজনের একটি বড় অংশ উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন করে কিছু করতে চান। অথচ তারা ব্যাংকের সেবা পান না। তাদের মর্যাদার চোখে দেখা হয় না। অথচ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এসব কর্মী যখন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে, সেখানে তাদের মর্যাদার জন্য সরকারের ভূমিকা রাখা উচিত।

রামরুর এক সমীক্ষার প্রসঙ্গে টেনে মেরিনা সুলতানা আরও বলেন, বিদেশ যেতে আগ্রহী ৯৭ ভাগ কর্মী দালালের সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতার কথা জানিয়েছে। কোনো রকম রশিদ ছাড়া দালালদের লাখ-লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছে লোকজন। দালাল যদি এ প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে থাকে, তাদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? কীভাবে তাদের দায়বদ্ধতায় আনা যায় সেটি ভেবে দেখতে হবে। অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক করতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) জাতীয় কর্মসূচি কর্মকর্তা রাহনুমা সালাম খান বলেন, সরকারের অনেক আইন ও নীতিমালা তৈরি করেছে। এগুলো কতটা বাস্তবায়ন হলো সেটা দেখা দরকার। বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এটি হলে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশের কর্মীদের বিদেশ পাঠানোটা মর্যাদার সঙ্গে করতে হবে। তেমনি দেশে ফিরে আসার পর তারা যেন মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কর্মীদের নির্যাতনের কথা তেমন শোনা যায় না। কারণ ওই দেশগুলো তাদের নাগরিকদের মর্যাদা দিচ্ছে। কাজেই রাষ্ট্র নিজে তার নাগরিকদের মর্যাদা না দিলে অন্য দেশ মর্যাদা দেবে না।