ঋণখেলাপি হলেও বৈধ প্রার্থী তাঁরা

সাইফুজ্জামান চৌধুরী, আবদুল মান্নান, মাহী বি চৌধুরী, শহীদুল হক জামাল
সাইফুজ্জামান চৌধুরী, আবদুল মান্নান, মাহী বি চৌধুরী, শহীদুল হক জামাল
>

*কয়েকজন প্রার্থী খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেননি
*ব্যাংক কোনো টাকা ফেরত পায়নি
*আদালত থেকে ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছেন
*ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁরা বিবেচিত হচ্ছেন না

৩০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নানের খেলাপি ঋণ ৮২ কোটি টাকা। সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হতে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজেই উল্লেখ করেছেন খেলাপি ঋণের এসব তথ্য। এরপরও তাঁকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন লক্ষ্মীপুর জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা।

একইভাবে অগ্রণী ব্যাংকে ৫০২ কোটি টাকার ঋণখেলাপি ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ পরিবারের পাঁচ প্রতিষ্ঠান। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এরপরও তাঁকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন চট্টগ্রামের রিটার্নিং কর্মকর্তা।

শুধু এই দুজনই নন, তাঁদের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক আরও কয়েকজন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করেননি, ব্যাংকের ধারেকাছেও যাননি। ফলে ব্যাংক কোনো টাকাও ফেরত পায়নি। উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে তাঁরা নিজের নামে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা সব ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। ফলে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁরা বিবেচিত হচ্ছেন না। এর মধ্যে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন কয়েক আগে, অনেকে অনেক আগেই। আবার কেউ কেউ ব্যাংকের মাধ্যমে নির্দিষ্ট টাকা জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিতও করেছেন। ব্যাংকাররা বলছেন, নির্বাচনের সময় আগে যেভাবে ঋণ আদায় হতো, এবার তেমনটা দেখা যায়নি। কারণ, ঋণখেলাপিরা এখন ব্যাংকে আসার চেয়ে আদালতেই বেশি যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এই প্রবণতা নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মাননীয় আদালতকে অনুরোধ করব, যাতে নির্বাচনের সময় স্থগিতাদেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি না হয়। এতে ব্যাংকগুলো বঞ্চিত হয়। কারণ, এ সময় গ্রাহকেরা কিছু টাকা ফেরত দেয়। ব্যাংকের জন্য হাইকোর্টে পৃথক তিনটি বেঞ্চ করার জন্য আমরা অনেক দিন ধরেই দাবি করছি। তাহলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হতো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একইভাবে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী, বিএনপির সাবেক হুইপ শহীদুল হক জামালও নির্বাচনে বৈধ প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের কারণে প্রার্থী হতে পারেননি জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, বিএনপির মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া, চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

হলফনামায় সানম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান উল্লেখ করেছেন, তাঁর নামে বর্তমানে ৭টি চেক জালিয়াতি ও ২টি অর্থঋণ আদালতের মামলা চলমান আছে। তাঁর হাতে নগদ রয়েছে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং শেয়ারবাজারে আছে ৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৮২ কোটি টাকা।

হলফনামার ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স করপোরেশন (বিআইএফসি) তাঁর কাছে ১৪৩ কোটি টাকা পায়। এর মধ্যে খেলাপি ৬০ কোটি টাকা। ২ ডিসেম্বর তাঁর ঋণের বিষয় জানাতে লক্ষ্মীপুর জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন বিআইএফসির একজন কর্মকর্তা। এ ছাড়া আরও ২০ টির বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তবে তাঁদের দাবি না শুনেই আবদুল মান্নানকে বৈধ প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।

এর কারণ ছিল, গত ১৬ অক্টোবর বিচারপতি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে বেঞ্চ তাঁর ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এর ফলে তাঁর ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে না। আবদুল মান্নান তা নিজেই হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।

বিআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোস্তফা বিলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল মান্নানের তথ্য নিয়ে আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলাম। রিটের কারণে আমাদের আপত্তি কাজে আসেনি।’

আবদুল মান্নানের কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা ১৫ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি। রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধানও বলেন, ‘আমরা আপত্তি করেছিলাম। রিটের কারণে আপত্তি টেকেনি।’

একইভাবে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, ব্যাংকে নগদ জমা রয়েছে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। নিজের পেশার পরিচয় দিয়েছেন এন্টারটেইনমেন্ট রিপাবলিকের কর্ণধার, ইনফো লিংকের চেয়ারম্যান, অ্যাভালন এস্টেটের এমডি ও কেসি মেমোরিয়ালের পরিচালক।

এন্টারটেইনমেন্ট রিপাবলিকের কাছে বিআইএফসির পাওনা ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গত রোববার হলফনামা যাচাইকালে বিআইএফসির প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে আপত্তি জানালেও রিটার্নিং কর্মকর্তা তা গ্রহণ করেননি। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় তাঁর নাম ছিল না।

সূত্র জানায়, স্থগিতাদেশের কারণে খেলাপির তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। এ কারণে প্রার্থী হতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি।

বিআইএফসির এমডি মোস্তফা বিলাল এ নিয়ে বলেন, ‘আমরা আপত্তি তুলেছিলাম। তা গ্রহণ করা হয়নি।’

এদিকে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী হলফনামায় উল্লেখ করেছেন, শেয়ারবাজারে তাঁর বিনিয়োগ আছে ৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং তাঁর স্ত্রীর বিনিয়োগ ৫ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী রুকমীলা জামান। ব্যাংকটির পরিচালকদের সিংহভাগ তাঁর পরিবারের সদস্য।

সূত্র জানায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান জাভেদ স্টিল, ভ্যানগার্ড স্টিলস, আসিফ স্টিল, আফরোজা ওয়েল ও আসিফ সিনথেটিকের ঋণ ৫০২ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অংশ ১০ শতাংশ। এসব ঋণের পুরোটাই খেলাপি হয়ে আছে, তবে ব্যাংকের তালিকায় তা নিয়মিত। কেননা, উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংকও কোনো আপত্তি তুলতে পারছে না।

অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক শহীদুল হক জামালও সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তিনি বিএনপির সাবেক হুইপ। ঋণকে খেলাপি হিসেবে না দেখাতে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন তিনি।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণখেলাপি অনেকেই আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন। এ কারণে খেলাপি হওয়ার পরও তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন। আমরা চেষ্টা করে অনেকের রিট শূন্য (ভ্যাকেট) করতে পারি। সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না, সময়সাপেক্ষও।’

এদিকে নির্বাচনে অংশ নিতে গত মাসে ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন সাংসদ। এর মধ্যে অন্যতম রাজশাহী-৪ আসনের এনামুল হক, চাঁদপুর-৪ আসনের শামসুল হক ভূঁইয়া, ঢাকা-১৪ আসনের আসলামুল হক, শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক, পটুয়াখালী-২ আসনের আ স ম ফিরোজ অন্যতম। আবার ঢাকা-১ আসনের প্রার্থী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সব ঋণ এখন নিয়মিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা ছাড়াও গ্রুপটিকে নতুন করে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে একাধিক ব্যাংক।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশির ভাগই ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চায় না। সবাই স্থগিতাদেশ নিয়ে বসে আছে। অনেকে এভাবে নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো কোনো টাকাই পাচ্ছে না। খেলাপি ঋণও আদায় হচ্ছে না।’