মুখ থুবড়ে পড়েছে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক

>

• ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণ ৪৭ শতাংশ
• এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ শতাংশ
• সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প
• তহবিল আছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার
• দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে আছে কার্যক্রম

অব্যবস্থাপনা তো আছেই। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্মী নিয়োগে রাজনৈতিক চাপ। আর এতেই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৪৭ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ শতাংশ।

মাঠপর্যায়ের তহবিল সংগ্রহ ও দেওয়া ঋণ তদারকির জন্য সরকার পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ১১ হাজার জনবল নিয়োগ অনুমোদন করেছিল। ছয় হাজার নিয়োগের পর অন্যদেরটা ঝুলে গেছে। মন্ত্রী ও সাংসদদের সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের বেশির ভাগই অকৃতকার্য হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে গেছে।

মূলত সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার’-এর অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকটির মাঠপর্যায়ের ঋণ তদারকি কার্যক্রম থমকে গেছে। ঋণ নেওয়ার পর সমিতিগুলো তা আর ফেরত দিচ্ছে না। ফেরত আসবে না এই ভয়ে প্রকল্পের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার তহবিল অলস পড়ে আছে। নতুন কোনো খাতে তা আর বিনিয়োগ হচ্ছে না।

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মিহির কান্তি মজুমদার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরিব মানুষ কখনো ঋণের টাকা মারবে না, এই বিশ্বাস আমাদের আছে। সমস্যা হচ্ছে ঋণ দেওয়ার পর তা আদায় করার জন্য যে জনবল দরকার, তা আমাদের নেই। নতুন করে সাড়ে পাঁচ হাজার জনবল নিয়োগের পরীক্ষা আমরা নিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করতে দেরি হচ্ছে। নিয়োগ হলেই আমরা দ্রুত বকেয়া ঋণগুলো আদায় করে ফেলব।’ 

নিজেই দুষ্টচক্রে
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নতুন কলেবরে ওই প্রকল্পটি আবারও চালু হয়।

প্রধানমন্ত্রীর ১০টি অগ্রাধিকার খাতের এক নম্বর তালিকায় থাকা এই উদ্যোগ নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা আছে, ‘ক্ষুদ্রঋণের উচ্চ সুদের হারের দুষ্টচক্র থেকে মানুষকে মুক্ত করা হবে। ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেলের মাধ্যমে টেকসই তহবিল গঠন করা হবে।’ কিন্তু গঠনের দুই বছরের মাথায় ব্যাংকটি নিজেই দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। ২০১৬ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় ২২ লাখ পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে ৬০ লাখ পরিবারকে সুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু এর মধ্যেই কর্মী নিয়োগে রাজনৈতিক চাপ ও আর্থিক কার্যক্রমে তদারকির অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যাংকের কার্যক্রম এখন যে হারে এগোচ্ছে, তাতে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। 

জনবল নিয়োগে তদবির
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে প্রথম দফায় ছয় হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে সাড়ে পাঁচ হাজার জনকে নিয়োগের জন্য একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে ১০ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নেন। গত জুনের মধ্যে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে সাড়ে পাঁচ হাজার জনের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এই লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পর থেকেই সাংসদ ও মন্ত্রীদের তরফ থেকে সুপারিশ আসতে থাকে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, যাঁদের নামে সুপারিশ এসেছে, তাঁদের বেশির ভাগই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন। এরপরই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ ও নিয়োগ আটকে যায়।

উল্লেখ্য, প্রতিটি গ্রামে ৬০ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত গ্রাম সংগঠনের সব সদস্যের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সঙ্গে সরকারি অনুদান যুক্ত করে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। যা প্রকল্পের এই অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্যই ২০১৬ সালে গঠন করা হয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। এর আর্থিক কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আর প্রশাসনিক তদারকি ও বিভিন্ন বিষয়ে অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সব কার্যক্রম পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। কেননা, ব্যাংকিং কার্যক্রম তদারকির অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশি। আর পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কোনো নিয়োগ ও ঋণ আদায় কার্যক্রমে দুর্বলতা থেকে থাকলে তার দায়িত্ব পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগকে নিতে হবে। তিনি মনে করেন, এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার জন্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের ওপরে নির্ভর করা উচিত নয়। ব্যাংকিং ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা ও তদারকি কমিটি গঠন করা উচিত।