ব্যবসায়ীকে জেল জুলুম হয়রানি

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে বিরোধ ছিল নাজমুস সাকিবের। বংশাল থানা–পুলিশের দুই কর্মকর্তা তাঁর সেই অংশীদারের পক্ষ নিয়ে কাজ করেছেন। সাকিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ দুই বছরের পুরোনো মামলায় চালান দিয়েছে। জেল খেটেছেন, গত দেড় বছরে ১৬ বার আদালতে হাজিরা দিয়েছেন, ব্যবসা হারিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তর বা ঢাকা মহানগর পুলিশকে নালিশ করেও বিচার পাননি। এই হলো নাজমুস সাকিবের অভিযোগ।

যে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনি, তাঁদের একজন বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাহিদুর রহমান, অপরজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শিমুল বিল্লাহ। সাকিবের একসময়ের ব্যবসায়িক অংশীদার ইমরান রহমান ওরফে সুমনের পক্ষ নিয়ে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই এই দুই পুলিশ কর্মকর্তাই তাঁকে জেলে আটক করেছিলেন। আইজিপি কমপ্লেইন সেলে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ আলাদাভাবে তিনটি তদন্ত করে। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আরশাদ অভিযুক্ত এএসআইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন বলে জানান। ঢাকা মহানগর পুলিশ একদফা তদন্ত শেষ করে নতুন করে আরও তদন্ত করেছে। ওসি এবং এএসআই আছেন আগের মতোই।

জানতে চাইলে শিমুল বিল্লাহ বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর সাহিদুর রহমান বিভাগীয় তদন্তের ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করার এখতিয়ার আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি কোনো উত্তর দেবেন না বলে জানান।

ঠিক কীভাবে বংশাল থানার পুলিশ তাঁকে গায়েবি মামলায় জড়াল—এমন প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেন, ইমরান রহমানের আইআর এন্টারপ্রাইজে ২০১৫ সালের দিকে তিনি প্রোডিজির ডায়াবেটিস মেশিন ও স্ট্রিপ সরবরাহ করতেন। প্রতিষ্ঠানটি তাইওয়ানের, এর কর্ণধার দারিয়া লাই। বছরখানেক পর প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইমরান তাঁকে অংশীদারি ব্যবসায় যোগ দিতে বলেন। সাকিব রাজি হন। হঠাৎ ইমরানের আচরণে তাঁর সন্দেহ হয়। কারণ, তিনি কোনো চুক্তি করছিলেন না। এমনকি প্রোডিজি মেশিনের নাম কিছুটা বদলে প্রোডিজি গোল্ড নাম দিয়ে চায়না থেকে মেশিন ও স্ট্রিপ বানিয়ে এনে বাজারে বিক্রি করছিলেন। সাকিব এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে ইমরান তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি আর এমন করবেন না এবং তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেবেন। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই ইমরান তাঁকে আলাপ-আলোচনার জন্য বংশালের হোটেল আল রাজ্জাকে যেতে বলেন। সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগে সাকিব সেখানে পৌঁছান। খাওয়াদাওয়া শেষে বিল দিয়ে বের হওয়ার সময় তিন পুলিশ সদস্য তাঁকে ধরেন। খানিক পর দেখেন ইমরানও আছেন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে।

গতকাল কথা হয় সাকিবের ব্যবসায়ী অংশীদার ইমরান রহমানের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, নাজমুস সাকিব মিথ্যা বলছেন। সাকিবের সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তিনি সাকিবকে ধরিয়ে দেননি। ব্যক্তিগত একটি ঝামেলার কারণে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সাকিব বংশাল থানায় পৌঁছার পর বারবার পুলিশের কাছে জানতে চান, তাঁর অপরাধ কী? শিমুল বিল্লাহ বলেন, তিনি বড় সন্ত্রাসী। ওপরের নির্দেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারবিরোধী পোস্ট দিয়েছেন। সাকিব বারবার অভিযোগ অস্বীকার করতে থাকেন। অনেক রাতে তাঁকে হাজতে ঢোকানো হয়। শিমুল বিল্লাহ মুঠোফোনে সাকিবের একটি ছবি তোলেন। ছবিটি দেখে মনে হয়, তিনি কারাগারে আটক। রাত গভীর হলে সাকিবের চোখ বেঁধে তাঁকে একটি কক্ষে নেওয়া হয়। তারপর তাঁকে বিএনপি চেয়ারপারসনের ভাষণ শোনানো হয়। তিনি বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এটা প্রমাণে পুলিশ নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। তিনি কিছুতেই স্বীকারোক্তি দেননি। পরদিন সকালে উপপরিদর্শক অঞ্জন সরকার এসে তাঁকে বংশাল থানার ওসি সাহিদুর রহমানের কাছে নিয়ে যান। ওসিও বলতে থাকেন, সাকিব বড় সন্ত্রাসী। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হবে। তা ছাড়া তিনি নকল ডায়াবেটিস মেশিন ও স্ট্রিপেরও ব্যবসা করেন। ওসি এ প্রসঙ্গ তোলার পরই সাকিব নিশ্চিত হন, তাঁকে তাঁর ব্যবসায়ী অংশীদার ইমরান ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। ওই দিনই দুপুরের দিকে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় কারাগারে। ১২ দিন জেল খেটে জামিনে বের হন সাকিব।

সাকিবকে ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই আটক করা হলেও গ্রেপ্তার দেখানো হয় বংশাল থানায় দুই বছর আগে দায়ের হওয়া একটি মামলায়। ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দায়ের হওয়া ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের বিচারের বিরুদ্ধে ওই দিন ১০–১২ জন মিছিল করেছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ আনা হয়।

জামিনে মুক্তির পর সাকিব তাইওয়ানের যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডায়াবেটিস মেশিন ও স্ট্রিপ আনতেন, সেই প্রতিষ্ঠান ওকে বায়োটেকের দারিয়া লাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি হাজতে শিমুল বিল্লাহর তোলা ছবিটি সাকিবকে পাঠিয়ে বলেন, ইমরান তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাকিব সন্ত্রাসী, তিনি কবে জেল থেকে ছাড়া পাবেন ঠিক নেই। ওকে বায়োটেক যেন সরাসরি তাঁর সঙ্গেই ব্যবসা করে।

তদন্ত কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় একাধিকবার সাকিবের সঙ্গে শিমুল বিল্লাহর দেখা হয়। তিনি সাকিবকে শাসান। সবশেষ শিমুল বিল্লাহ গত ২৮ আগস্ট ফোন করেন সাকিবকে। সাকিবকে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলেন। সেই অডিও রেকর্ডও সাকিবের কাছে আছে।