মুক্তিযুদ্ধ-সখা এডওয়ার্ড কেনেডি

এডওয়ার্ড কেনেডি

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। যুদ্ধের মাঠে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, শরণার্থী শিবিরে, প্রতিবাদে বা জনমত গঠনে কঠিন সেই সময়ে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন। সেই বন্ধুদের কয়েকজনকে নিয়ে এ আয়োজন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ঘোর সমর্থক ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরকারের একচোখা নীতি এক পা বাড়িয়ে বাস্তবায়ন করতেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।

কিন্তু ওই মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরেই ছিল বাংলাদেশের অনেক সুহৃদ। সে সময়ের মার্কিন সিনেটের কার্যবিবরণীতে দেখা যাবে, একজন সিনেটর প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন তাঁর দেশের সরকারের নীতির বিরুদ্ধে। সোচ্চার তিনি পূর্ব বাংলার পাইকারি গণহত্যার বিরুদ্ধে। লাখো শরণার্থীর জীবন বাঁচানোর নিরবচ্ছিন্ন তাগিদ তাঁর কণ্ঠে। তিনি সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৯ বছর। মার্কিন রাজনীতিতে প্রভাবশালী কেনেডি পরিবারের তরুণ এই সদস্য তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় একাত্তরে মানবতার মুখপাত্র হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে।

১১ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও মার্কিন সিনেটে এডওয়ার্ড কেনেডির বক্তৃতা–বিবৃতির ক্রম থেকে সহজেই বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি ছুটে এসেছিলেন ভারতে, খুলনা সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে। স্বচক্ষে দেখেছেন মানুষের দুর্দশা।

একাত্তরের ১১ আগস্ট মাদার তেরেসাসহ কলকাতায় একটি ফিল্ড হাসপাতাল পরিদর্শন করেন কেনেডি। এরপর দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে নিক্সন-নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি পাকিস্তানেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া তাঁকে ভিসা দিতে রাজি হননি। এডওয়ার্ড কেনেডি ছিলেন মার্কিন সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক জুডিশিয়ারি উপকমিটির চেয়ারম্যান।

এর আগে ৩ মে মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের হুমকি মোকাবিলার আহ্বান জানান তিনি। জাতিসংঘকে তৎপর হওয়ার তাগিদ দেন। ২২ জুন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উদ্দেশে সিনেটে বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যম থেকে জানলাম গত রাতে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মা অস্ত্রবোঝাই করে নিউইয়র্ক থেকে করাচি যাত্রা করেছে। এটা মার্কিন নীতির চরম লঙ্ঘন। ভয়ংকর বিপদ হচ্ছে এসব অস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সেই রসদ জোগাবে, যা দিয়ে তারা ইতিমধ্যে ৬০ লাখ লোককে শরণার্থী বানিয়েছে, অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।’ ৭ ডিসেম্বর সিনেটে দেওয়া দীর্ঘ বক্তৃতায় কেনেডি বাংলাদেশে নয় মাসে ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশ সফরে আসেন। ২০০৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪৭ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুয়েটস রাজ্যের সিনেটর ছিলেন। আর ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত করে।