'প্রাসাদ' ছেড়ে আত্মগোপনে

ইয়াবা। ফাইল ছবি
ইয়াবা। ফাইল ছবি
>

• অভিযানে টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসায়ী কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত
• এক মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৮ জন নিহত হয়েছে
• এক লাখের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছে পুলিশ
• নিরাপদে থেকে ব্যবসা চালাচ্ছেন ইয়াবা ব্যবসায়ীরা

ছয়-সাত বছর আগেও টেকনাফ সদরের জালিয়াপাড়ার মো. জুবায়ের ছিলেন বেকার। ইয়াবার ছোঁয়ায় রাতারাতি বদলে যায় তাঁর চলন-বলন। দু-তিন বছর আগে একটি দোতলা বাড়ি করেন। দেখতে রাজপ্রাসাদের মতো।

গত পাঁচ-ছয় বছরে টেকনাফে এ রকম বেশ কিছু বাড়ি নির্মিত হয়েছে। কয়েক বছর আগেও যাঁরা মুরগি বিক্রেতা, লবণশ্রমিক, রিকশাচালক, দোকান কর্মচারী, গাড়ির সহকারী বা বেকার ছিলেন, তাঁরাই বাড়ির মালিক। তবে আলিশান বাড়ি থাকলেও মালিক ও তাঁদের পরিবার সেখানে বাস করছে না। দেড় মাস ধরে তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারপরও বন্ধ হয়নি ইয়াবা ব্যবসা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপদ অবস্থানে থেকে ব্যবসা চালাচ্ছেন ইয়াবা কারবারিরা।

পুলিশের অভিযানের কারণে টেকনাফের এসব ইয়াবা ব্যবসায়ী কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত। গত এক মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮ জন নিহত হন। এ সময় পুলিশ এক লাখের বেশি ইয়াবা ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবার ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ এলাকাছাড়া। তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, এক মাসের বেশি সময় ধরে টেকনাফ থানার পুলিশ প্রায় ৪০টি বাড়িতে হানা দিয়েছে। এগুলো তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাড়ি।

ইয়াবার রাজা
মো. ছিদ্দিক ছিলেন ছিল লবণমাঠের শ্রমিক। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ প্রায় ১০টি মামলা রয়েছে। গত ৮ অক্টোবর রাত একটায় পুলিশ টেকনাফ সদরের বড় হাবিবপাড়ার মো. ছিদ্দিকের বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। একই তিন রাত দেড়টায় পুলিশ হানা দেয় একই এলাকার মো. হাসানের বাড়িতে। তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখা যায় পুলিশ আসার আগমুহূর্তে বাসিন্দারা পালিয়েছে। ইয়াবার শীর্ষ ব্যবসায়ী সাইফুল করিমের শিলমনিয়াপাড়ার বাড়ির চারদিকে সিসি ক্যামেরা লাগানো। ওই বাড়ি থেকে দুজন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

নাজিরপাড়া এলাকার একরামের বাড়ির ফটকটি যেন সিংহদুয়ার। সেখানে গিয়েও কাউকে পায়নি পুলিশ। একরাম ছয় বছর আগেও ছিলেন বেকার। আর জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল জালের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। পুলিশ ফিরে যাওয়ার পর তাঁর বাড়িটি কে বা কারা ভেঙে দিয়েছে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে গায়েবি হামলা করেছে।

ভয়ে পুলিশও
ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযানের পর অনেক পুলিশ সদস্যও ভয়ে আছেন। ভয়ের কারণ পুলিশ সদর দপ্তরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএনপিএস)। অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী অতীতে পুলিশের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ পাঠিয়েছে।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘আমার পুলিশ সদস্যরা আমাকে ছাড়া অভিযানে যেতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের ভয়, কেউ যদি একটা ভুয়া অভিযোগ করে দেয়, সেটির তদন্তে নামবে ডিএনপিএস। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন, এমন আশঙ্কা করছেন।’

বিষয়টি স্বীকার করে পুলিশ সুপার বলেন, অতীতে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাঠিয়েছেন। ডিএনপিএস অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করেছে। তদন্ত হতেই পারে। কিন্তু এলাকাটা খারাপ। কেউ ভালো কাজ করলে অনেকে ভালো চোখে দেখে না। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

বিজিবি টেকনাফ-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদ জামান চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ ইয়াবা ব্যবসা করবে আবার ঘরে বসে গরম ভাত খাবে, তা হবে না। পুলিশ এবং আমরা তাদের শান্তি দেব না। পালিয়েছে তারা। এখন ব্যবসা কমে এসেছে।’

তালিকায় বদিসহ ২৩ জনপ্রতিনিধি
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা ৭৩ প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারির (গডফাদার) তালিকায় সাংসদ আবদুর রহমান বদির পাশাপাশি আরও ২২ জনপ্রতিনিধির নাম রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন উপজেলার চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যের নাম রয়েছে।

গত জুন মাসে তৈরি হওয়া এই তালিকায় টেকনাফ উখিয়া আসনের সাংসদ বদির পাঁচ ভাইসহ ১০ স্বজনের নাম আছে। টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাফর আহমদ ও তাঁর চার ছেলে এবং এক জামাতাও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ মো. আলীর দুই ছেলেও এই তালিকায় রয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-দলীয় অনেকের নাম এই তালিকায় রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) ডিআইজি সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত ওই তালিকা জুন মাসের শেষ দিকে কক্সবাজার কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

একই তালিকায় কক্সবাজারে ইয়াবার ৩০ রুট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা ঢোকার প্রধান রুট কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত।