ধানের লোকসানে কৃষকের মনে নেই ভোটের আমেজ

খেত থেকে কেটে নিয়ে আসার পর বাড়ির উঠানে ধান মাড়াই করেছে একটি পরিবার।  সম্প্রতি তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি এলাকা থেকে তোলা ছবি: প্রথম আলো
খেত থেকে কেটে নিয়ে আসার পর বাড়ির উঠানে ধান মাড়াই করেছে একটি পরিবার। সম্প্রতি তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি এলাকা থেকে তোলা ছবি: প্রথম আলো

সারা দেশে বিরাজ করছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ। কিন্তু সেই আমেজ নেই রংপুর–২ আসনের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার কৃষকের মধ্যে। সংসার চালাবেন কীভাবে, সেই চিন্তায় দিন পার হয় তাঁদের। কারণ, তাঁরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না। অনেক সময় উৎপাদন খরচও ওঠে না, গুনতে হয় লোকসান। চলতি আমন মৌসুমেও একই পরিস্থিতি বাজারের।

এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন, এমন প্রশ্ন করতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার মেনানগর গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান।  তিনি বলেন, ‘ভুঁই চাষ করি হামার সংসার চলোচে না। যেবারে ধান আবাদ করি, সেইবারে বেচেয়া খরচে ওঠে না। তাহইলে কন তো সংসার চলাই কী দিয়া, খাই কী? ছইল-পইলোক পড়াই কী দিয়া। আর আবাদটা করি কেমন করি? কোনটে পাই টাকা!। হামার পিতি (প্রতি) কাঁয়ো দ্যাকে না। ভোটঘোট করি হামার লাভ কী? তারপরও এবার দেকমো, জায় হামার ধানের দাম বাড়বার চাইবে, তাঁকে ভোট দেমো।’

ওই কৃষকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরেক কৃষক নাল্টু মিয়া বলেন, ‘আচ্ছা এই দ্যাশটাত কেষক বেশি নাকি চাকরিয়া বেশি? চাকরিয়ারা তো ভোট নেয়, ভোট দেয় না। হামরা ভোট দিই তেমনি ওরা ক্ষেমোতাত বইসে। চাকুরিয়ার বেতন বাড়াইতে আছে, সার-কীটনাশক, কাগজ-কলম, কাপড়চোপড় সবকিছুর দাম বাড়োওচে। তাহইলে কেষক বাঁচপে কেমন করি!’

ওই গ্রামের কৃষক মনছার আলী বলেন, ‘খুশি মনোত জায়া ভোট দিবার নাগে। ধানের দাম নাই। হামার ওপরোতো কষ্ট, মনোতো কষ্ট।’

তারাগঞ্জের জলুবর গ্রামের কৃষক জমসের আলী  বলেন, ‘ভোট আইলে সবায় বুকোত জড়ে ধরে। কয় তোমার সউগ সমস্যা দেকমো। ভোট গেইলে আর মনে থাকে না। কৃষকের কী অবস্থা সেই খবর কাঁয়ো থোয় না। এবার দেখিশুনি ভোট  দেমো। জায় ধানের দাম বাড়াইবে তাঁর মার্কাত ছিল মারমো।’

 নির্বাচন নিয়ে একই প্রশ্ন করা হয় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার আমরুলবাড়ি আসমতপাড়া গ্রামের কৃষক বরকত আলী সরকারকে (৪৫)। প্রশ্ন শুনেই এ প্রতিবেদকের চোখের দিকে কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকে বলেন, ‘ভোট কি হামাক ভাত দেবে? এক মণ (২৮ কেজি) ধান আবাদ করতে খরচ ৫০০ টাকা। তাক বেচাওচি ৪০০ টাকাত। আবাদ খরচ থাকি ১০০ টাকা নাই। চলে কেমন করি! গরুর খাবার কিনবার যাইবেন ভুসি ৪০-৫০ টাকা কেজি। একটা গাইয়োক (গাভি) দিনে ৪-৫ কেজি চোপড়-ভুসি খিলবার নাগে। এক লিটার দুধ বেচেয়া পাই ৩২-৩৫ টাকা। গরু বেচবার যাইমেন দাম নাই। এককথায় কেষকের ঘরোত যেটা আছে, সেটা বেচপার গেইলেই লস। আর যেটা নাই, সেটা কিনলে দাম ৩-৪ গুণ বেশি। হামরা কী করি বাঁচি থাকমো, সেই চিন্তা করি কুল পাওচি না। হামার কতা, যেই সরকার ফসলের দাম বাড়াইবে হামরা এবার তাকে ভোট দেমো।’ 

 তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আমন চাষ মূলত বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এবারে এলাকায় তেমন বৃষ্টি হয়নি। এ কারণে শুরু থেকেই বোরোর মতো আমন চাষও সেচনির্ভর হয়ে ওঠে। এতে এবারে আমন চাষে কৃষকের খরচ বাড়লেও ধানের দাম কমেছে। গত মৌসুমের চেয়ে ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ৮০-৯০ টাকা। সরকার ধান কিনছে না। গত বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি চাল সরকার কিনেছে ৩৮ টাকায়। এবারে আমনে ৩৬ টাকা দরে সরকার চাল কেনার ঘোষণা দিলেও এখনো কেনা শুরু করেনি। বর্তমানে ধানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

তারাগঞ্জের ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, গ্রামের কৃষকেরা এক ফসল বিক্রি করে আরেক ফসল চাষ করেন। অনেকে ঋণ নিয়ে আবাদ করেন। ফসল ওঠার সঙ্গে সেগুলো বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেন। অন্য ফসল চাষের খরচও মেটান। এতে কৃষক ধান মজুত করে রাখতে পারেন না। কাটা-মাড়াই মৌসুমের শুরুতেই ধানের দাম থাকলে কৃষকেরা উপকৃত হতেন।

তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অসোক কুমার ও বদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা কনক চন্দ্র রায় জানান, বৃষ্টির অভাবে এবারে এলাকায় আমন চাষ সেচনির্ভর হয়ে পড়েছিল। এ কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কৃষক মণপ্রতি (২৮ কেজি) ধান ৫০০ টাকার নিচে বিক্রি করলে কোনোভাবেই পোষাতে পারবেন না। কিন্তু বর্তমানে বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ৪২০-৪৩০ টাকায়।