ক্ষমতায় গেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার বয়সসীমা তুলে দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম চলমান রাখবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের তালিকা করবে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এমন ৩৫ দফা অঙ্গীকারের ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
আজ সোমবার সকালে রাজধানীর হোটেল পূর্বাণীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহার ঘোষণা করে। ইশতেহার পাঠ করেন জোটের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
ঐক্যফ্রন্টের ৩৫ দফা ইশতেহারের মধ্যে আছে—রাষ্ট্র পরিচালনায় পরাজিতদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। ডেপুটি স্পিকার হবে বিরোধী দল থেকে। তারা নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান তৈরি করবে। পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান রাখার পাশাপাশি তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেওয়া হবে।
ইশতেহারে আরও আছে—মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা থাকবে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশে সরকারি বিধি-নিষেধ থাকবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ বাজেটের ৩০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া ঢাকার কাছে উন্নত নাগরিক সুবিধাসহ কয়েকটি শহর গড়ে তোলা হবে।
ঐক্যফ্রন্ট বলছে, পুলিশ ও সামরিক বাহিনী বাদে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোনো বয়সসীমা থাকবে না। অনগ্রসর ও প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কারও জন্য কোটা থাকবে না। ৩০ বছরের বেশি শিক্ষিত বেকারদের জন্য বেকার ভাতা চালুর জন্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দেখতে কমিশন গঠন, পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, ডাকসুসহ ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিশ্চিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে প্রশাসনের হাতে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি চালু হবে।
ক্ষমতায় গেলে ঐক্যফ্রন্ট দুর্নীতি দমনে ব্যবস্থা নেবে। দুর্নীতির তদন্তের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে সরকারের অনুমতির বিধান বাতিল করা হবে। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা আছে ঐক্যফ্রন্টের। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা, সব জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, সিসিইউ, আইসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার, ক্যানসারের কেমোথেরাপি সেন্টার গড়ে তুলবে ঐক্যফ্রন্ট। ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ কমানোর কথাও বলেছে তারা। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩-এর সংস্কারসহ খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক ধার্য করা হবে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রিমান্ডে নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধের কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। রিমান্ডের নামে পুলিশি হেফাজতে যেকোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা হবে। সাদাপোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া মামলাজট কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপের সঙ্গে উচ্চ আদালতের বার্ষিক ছুটি ছয় সপ্তাহে সীমিত করা হবে। বিভাগীয় সদরে স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স করা হবে ৭০ বছর।
কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো, শিল্পোন্নয়ন, ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছরের মধ্যেই শ্রমিকদের মজুরি ১২ হাজার টাকা করার কথা বলছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ লুটপাটে জড়িত লোকজনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাংক পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। বয়স্ক ভাতা চালু, পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ না করাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেবে ঐক্যফ্রন্ট। সংরক্ষিত নারী আসনের প্রথার পরিবর্তে সরাসরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ২০ শতাংশ মনোনয়নের বিধান করে দুই মেয়াদের পর আর সংরক্ষিত আসন না রাখার কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। এ ছাড়া কোনো বিশেষ ব্যবস্থা ছাড়াই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর করা হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার এবং শিক্ষার্থীদের ৯ দফার আলোকে সড়ক আইন সংশোধন করা হবে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় দায়িত্বরত সাংবাদিক নিগ্রহের বিচারের কথা বলেছে ঐক্যফ্রন্ট। প্রবাসীদের ভোটাধিকারসহ প্রবাসী কর্মীদের বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়া হবে। সাংবাদিকদের মজুরি বোর্ড নিয়মিত করা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাতে উৎসাহ প্রদানসহ সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হবে। ইন্টারনেট ও মোবাইল খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনা, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় করা, তাদের ওপর হামলার বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করা। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করার কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন, ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী ও মোস্তফা মোহসীন মন্টু, বিএনপির আবদুল আউয়াল মিন্টু, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরউল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।