ঢাকা-১৬: মোল্লাহ্বাড়িরই আওয়াজ বেশি

‘মোল্লাহ্‌বাড়ি’র সামনে সড়কে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র নির্বাচনী প্রচারের ব্যানার। ছবি: কমল জোহা খান
‘মোল্লাহ্‌বাড়ি’র সামনে সড়কে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র নির্বাচনী প্রচারের ব্যানার। ছবি: কমল জোহা খান

ঘূর্ণিঝড় ফেথাইয়ের ঝিমানো বৃষ্টিতে ছিঁড়ে গেছে পোস্টারগুলো। কিন্তু বাড়ির সামনে ব্যানার রয়েছে অনেক। বড় বড় ব্যানারের অর্ধেকজুড়ে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র ছবি, ছবির পাশে নৌকা প্রতীক। এই ব্যানার দিয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের পক্ষে ভোট চাইছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত এই প্রার্থী। যে বাড়ির সামনের সড়কে এসব ব্যানার টাঙানো, সেটি দিনরাত ব্যস্ত থাকে। বাড়িটি সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র পৈতৃক নিবাস। পরিচিত ‘মোল্লাহ্‌বাড়ি’ নামে।

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র বাবা হারুন মোল্লাহ্‌ ছিলেন ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সাংসদ। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জয় পান তিনি। হারুন মোল্লাহ্‌ হারিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে। হারুন মোল্লাহ্‌র আকস্মিক মৃত্যুতে বহুল আলোচিত উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জয় পান বিএনপির এস এ খালেকের ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ মহসিন। এরপর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোল্লাহ্‌ পরিবারের কাছ থেকে হাতছাড়া থাকে মিরপুরের আসনটি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে মিরপুরের আসনটি ভেঙে তিনটি হয়। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে দুই সংসদ নির্বাচনে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌ই বিজয়ী হন।

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র হ্যাটট্রিক মিশনে প্রতিদিন বিকেল হতেই প্রচারে জমজমাট হয়ে যায় মোল্লাহ্‌বাড়ির আঙিনা। এখান থেকে গাড়িবহর নিয়ে বর্তমান সাংসদ প্রচারে চলে যান মিরপুর–পল্লবীর সড়ক থেকে অলিগলিতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলেও প্রচারে নামেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিল গোটা তিনেক টয়োটা প্রাডো, আর হাজার খানেক নেতা-কর্মী ও সমর্থক। ১২ নম্বর থেকে ৬ নম্বর সেকশন এসে নেমে মিছিল করেন। সাংসদের মিছিলটি একসময় অলিগলি পেরিয়ে আসে ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ১৩ নম্বর সড়কে। এই সড়কে রয়েছে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আহসান উল্লাহ হাসানের বাড়ি। সড়কটির সংস্কারকাজ চলছে। ইট–সুরকি ফেলা। হয়তো কিছুদিন পর পিচ ঢেলে চলাচলের উপযোগী করা হবে।

প্রতিপক্ষের বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল করার সময় হাত নাড়ালেন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌। কিন্তু তাঁর সমর্থকেরা হাসানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে ডি ব্লকের সামনে পথসভা করলেন ইলিয়াস মোল্লাহ্‌। সেখানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌ তাঁর দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ করেন।

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌ বলেন, ‘৬ নম্বরের এই জায়গায় আমার নির্বাচনী অফিস। সোমবার রাতে হাসানের লোকজন এখানে ভাঙচুর করেছে। জাতির জনক, প্রধানমন্ত্রী, সাংসদের ছবি ছিঁড়েছে। জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলেছে।’ এর কারণে মামলা করেছেন তিনি। এর আগেও হাসানের কর্মীরা আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌।

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌ যখন প্রতিপক্ষের আবাসস্থলের সামনে দিয়ে মিছিল করছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। নাম আবদুর রশীদ। হাসানের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসান তো নেই। এখানে থাকেন না।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি হাসানের শ্বশুর। এটি আমার বাড়ি। পাশে হাসানের বাড়ি। হাসানের বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা রয়েছে। তাই প্রচারে নামতে পারছে না।’

ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আহসান উল্লাহ হাসানের বাড়ি। সুনসান চারদিক। তাঁর পক্ষে কোনো পোস্টার পর্যন্ত নেই। ছবি: কমল জোহা খান
ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আহসান উল্লাহ হাসানের বাড়ি। সুনসান চারদিক। তাঁর পক্ষে কোনো পোস্টার পর্যন্ত নেই। ছবি: কমল জোহা খান

পরে কথা হয় হাসানের বাড়ি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। এক বাসিন্দা জানান, এখানেও হাসানের পক্ষে কোনো পোস্টার টাঙানো নেই। সব নৌকার পোস্টার। ১৫ ডিসেম্বর হাসানের স্ত্রী রিনা হাসান লিফলেট বিতরণ করার সময় ঘেরাও করে প্রতিপক্ষ। তারপর মারধরের ঘটনা ঘটে। এরপর হাসানের স্ত্রী ও শ্যালিকাকে পল্লবী থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। অসুস্থতার কারণে পরে রিনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

আজ বুধবার প্রথম আলোকে রিনা হাসান বলেন, ‘মারধরের কারণে আমি মাথা ও হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পাই। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে, তারপর ঢাকা মেডিকেলে, সেখান থেকে মিরপুরের আল শাফি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় আমাকে। সেখানে জড়ো হয় ইলিয়াস মোল্লাহ্‌র লোকজন। হাসপাতালে গিয়েও চিৎকার–চেঁচামেচি করে তারা। তাই বাধ্য হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বাবার বাসায় চলে এসেছি।’

তবে বাধা এলেও প্রচারে নামবেন বলে জানান হাসান। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা। সব কটিতে জামিন পেয়েছি। সার্টিফায়েড কপি পেলে দুই–তিন দিনের মধ্যে প্রচারণায় নামব।’ পোস্টার–ব্যানার নেই কেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নামলেই মারধর করে। ধরে নিয়ে যায়। আমার বাড়ির সামনেই ঘেরাও করে রাখে। পোস্টার টাঙানোর পর ছিঁড়ে ফেলে।’

প্রতিপক্ষের এসব অভিযোগ সম্পর্কে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, ‘আসল কথা শোনেন। আমার নির্বাচনী অফিস তারাই পোড়াইছে। পেট্রলবোমা, আগুন–সন্ত্রাস যারা আগে করছে, তারা এগুলো করেছে। এখন উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে।’

পক্ষ-বিপক্ষের এত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার জাকির হোসেন বলেন, হাসান বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

হাসানের স্ত্রী রিনা হাসান বলেন, ‘মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটি নেয়নি। আমাদের উচ্চ আদালতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।’