প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও হামলা-মামলা বন্ধ হচ্ছে না

ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। নারায়ণগঞ্জ, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: হাসান রাজা
ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। নারায়ণগঞ্জ, ২১ ডিসেম্বর। ছবি: হাসান রাজা

সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও গ্রেপ্তার-মামলা বন্ধ হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আগের নির্বাচনগুলোর বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে সত্যবাদী বলা যাবে না।

আজ শুক্রবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সোনাকান্দা স্টেডিয়াম মাঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে এ কথা বলেন মির্জা ফখরুল।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এক অদ্ভুত নির্বাচন হচ্ছে দেশে। এক নির্বাচন কমিশনার গতকাল বলেছেন, দেশে নাকি নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। এমনই সুবাতাস যে আমরা পারমিশন নেওয়ার পরও মাঠে সমাবেশ করতে পারি না, মঞ্চ করতে পারি না, মাইক লাগাতে দেওয়া হয় না। রাস্তায় আটকে দেওয়া হয়। আমাদের ১৬ জন প্রার্থীকে জেলে পাঠিয়েছে। গত রাতেও একজনকে ধরে নিয়ে গেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন, কারাগারে যাচ্ছেন কিন্তু জামিন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যখন আলোচনা হলো, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, তফসিলের পর গ্রেপ্তার হবে না। তাঁকে কি আমরা সত্যবাদী বলব? না, বলা যাবে না।’

সরকারের গত সময়ের সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, কয়লা খেয়ে ফেলেছে, সোনা তামা হয়ে গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক হয়ে গেল। আর উন্নয়ন বলি, বগুড়া থেকে সড়কপথে ঢাকা আসলাম, ৬ ঘণ্টা লাগল। প্রতি রাস্তায় খানাখন্দ, গোটা বাংলাদেশে একই অবস্থা। উন্নয়ন হয়েছে, তবে শুধু তাদের উন্নয়ন হয়েছে, তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আর আপনার পকেট খালি হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০ গুণ, গ্যাস দাম বেড়েছে, বাড়িভাড়া বাড়ছেই। ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে বলেছে, চালের কেজি ৬০ টাকা। বিনা মূল্যে সার দেবে বলেছে, সারের দাম ১২০০ টাকা। ভেবেছে সারা দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে পার পেয়ে যাবে। ঘরে ঘরে চাকরি দেবে বলেছে, কিন্তু চাকরি নাই। লাখ টাকার নিচে চাকরি নাই। তাও আবার ডিএনএ পরীক্ষা করিয়ে আওয়ামী লীগ হতে হবে।’

পরে মির্জা ফখরুল নিজেরা ক্ষমতায় এলে কী করবেন, সেসব বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। যাদের চাকরি হবে না, তাদের জন্য বেকার ভাতা চালু করা হবে। তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রার্থীদের হাত তুলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘প্রার্থীদের নয়, খালেদা জিয়াকে ভোট দিতে হবে।’ এত বাধার মধ্যেও নির্বাচনে জয়ী হতে হবে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলেছিলেন। এমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যে একদল মঞ্চ করে হাজার হাজার লোক নিয়ে হেলিকপ্টারে করে, পতাকা উড়িয়ে সভা করছে আর আমাদের সভা করতে দেওয়া হয় না।’

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি প্রার্থী এস এম আকরামের সমর্থনে সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল সিরাজউদ্দৌলা মাঠে। কিন্তু ওই মাঠে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কমিশনার এক ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করবেন বলে ঐক্যফ্রন্ট অনুমতি পায়নি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, জাতি এখন সংকটময় মুহূর্ত কাটাচ্ছে। দেশের মানুষকে এ নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা অন্ধকারে থাকবে, নাকি আলোর পথে যাত্রা করবে। খালেদার জিয়ার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘মায়ের মুখের হাসির জন্য ধানের শীষে ভোট দিতে হবে।’ আওয়ামী লীগ ভোট চুরি করতে ওস্তাদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভোটের আগের রাত থেকে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে হবে।’

পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ। ওদের কিচ্ছু করার নাই। অসহায় অবস্থায় তাকিয়ে থাকে। আমরা যা-ই বলি, চুপ করে বসে থাকে। তাদের বলি, কোমর সোজা করে দাঁড়ান। সংবিধান যে দায়িত্ব দিয়েছে, সে দায়িত্ব পালন করুন। অন্যথায় পদত্যাগ করুন। না পারলে চলে যান, দেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে। কিন্তু যদি অন্যায় করেন, মানুষ মেনে নেবে না।’

প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এত কিছুর পরেও কথা শোনানো বন্ধ করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘জনগণের কল্যাণের চিন্তা নাই। শীতলক্ষ্যা নদী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ত্বকী হত্যার বিচার নাই, আমাদের ওপর চেপে বসতে চায়।’

ভোটের দিন সবাইকে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ভোট দিতে যেতে বলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এরপরে খেয়েদেয়ে আবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট গুনে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বলেন তিনি। মান্না বলেন, ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁরা সহ্য করবেন, কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর তারা সহ্য করবেন না।

এবারের নির্বাচন জাতির বেঁচে থাকার নির্বাচন বলে সমাবেশে মন্তব্য করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপি প্রার্থী এস এম আকরাম অভিযোগ করেন, যে মাঠে তাঁরা সমাবেশে করতে চেয়েছেন, সেখানে অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মাইক লাগাতে দেওয়া হয়নি।

সমাবেশে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালের সভাপতিত্বে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের বিএনপির প্রার্থী মনির হোসাইন কাশেমি, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের কাজী মনিরুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের নজরুল ইসলাম আজাদ প্রমুখ। সমাবেশে প্রায় ছয় হাজার লোকের সমাগম ঘটে বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান।

সমাবেশে আসার পথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গাড়িবহরকে বাধা দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর চৌরাস্তায় বাধা দেওয়া হয়। এ সময় বন্দর মদনপুর সড়কের প্রবেশমুখে শুকনা কাঠ ও বাঁশে আগুন লাগিয়ে সড়ক অবরোধ করা হয়। এতে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট যান চলাচল বন্ধ ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন জানান, ঐক্যফ্রন্টের গাড়িবহরে বাধা দেওয়া হয়েছে। প্রায় আধা ঘণ্টা ঐক্যফ্রন্টে গাড়িবহর বাধার মুখে আটকে ছিল। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের তত্ত্বাবধানে নেতাদের গাড়িবহর পুলিশি পাহারায় বিকেল চারটার পর সমাবেশস্থল সোনাকান্দা মাঠে নিয়ে আসে।