স্বাস্থ্যের তথ্য লুকাচ্ছে সরকার

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।
>

• চিকিৎসাসেবা পরিস্থিতি
• সব ধরনের সেবার ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রস্তুতির মান নিম্নপর্যায়ের
• গত তিন বছরে উন্নতি হয়নি বলে খসড়া প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে
• মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যে অর্জন ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ
• সেবা দিতে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত থাকে না

দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল চিত্র উঠে আসা তিনটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না সরকার। গত বছর মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করার দেড় সপ্তাহ পর ওয়েবসাইট থেকে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার জন্য এখনো আটকে আছে। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য ৯ মাস আগে সংগ্রহ শেষ হলেও তা প্রকাশিত হয়নি। আর বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপের কাজ শেষ হয়েছে গত বছর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্বাস্থ্য খাতের অপ্রিয় তথ্য সরকার প্রকাশ করতে চায় না।

এই তিন জরিপের মূল দায়িত্বে রয়েছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)। জরিপ প্রতিবেদনগুলোর ব্যাপারে জানতে চাইলে গত ২৫ নভেম্বর নিপোর্টের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত কম সময়ের মধ্যে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছি।’

মাতৃমৃত্যুর হার কমেনি
রাজধানীর একটি হোটেলে গত বছরের ২২ নভেম্বর ঘটা করে ২০১৬ সালের মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। প্রতি লাখে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এ তথ্য বাংলাদেশের সাফল্য ও অর্জনের ঠিক বিপরীত বার্তা দিয়েছিল। কারণ, ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৯৪।

অনুষ্ঠানের দিনই নিপোর্ট তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ১০৬ পৃষ্ঠার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। অনুষ্ঠানেও বিলি করা হয় ছাপানো প্রতিবেদন। কিন্তু দেড় সপ্তাহ পর ৩ ডিসেম্বর ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে নেয় নিপোর্ট। তারা ছাপানো প্রতিবেদন বিলিও বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তখন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা জরিপের তথ্য মানতে পারছি না।’ আর নিপোর্টের তৎকালীন মহাপরিচালক রওনক জাহান বলেছিলেন, জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জরিপ প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, আইসিডিডিআরবি, দাতা সংস্থা ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে। পর্যালোচনা কমিটি গত মার্চে কারিগরি কমিটির হাতে বিষয়টি ছেড়ে দেয়।

কারিগরি কমিটির সদস্যসচিব ও নিপোর্টের মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আহছানুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি কমিটি ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে পর্যালোচনা কমিটিতে মতামত পাঠাবে। এরপর মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক প্রথম আলোকে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে না, প্রকাশও করা হবে না।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের যেসব অর্জন ও সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরা হয়, তার একটি মাতৃমৃত্যু হ্রাস। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর একাধিক বইয়ে এই সাফল্যের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারও স্বাস্থ্য খাতে অর্জন তুলে ধরার সময় অমর্ত্য সেনকে উদ্ধৃত করে। কিন্তু সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু জরিপের ফলাফল সেই সাফল্য কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে।

মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ২১৪ নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে প্রতি পাঁচজনের একজন গর্ভবতী মা স্বাস্থ্যসেবা পান না। প্রসবের আগে, প্রসবকালে, এমনকি প্রসব-পরবর্তী কোনো সেবা এই মা পান না। মৃত্যুর কারণ চিকিৎসকদের মাধ্যমে যাচাই করে নিশ্চিত করা হয়েছিল।

ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদন সরিয়ে বা প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্ব করে কর্মকর্তারা ঠিক কাজ করেননি বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও জনস্বাস্থ্যবিদ রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জরিপের ফলাফল মাঠপর্যায়ের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়। স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের জন্য এসব তথ্য খুবই জরুরি। এসব তথ্য প্রকাশ পেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, এ কারণে হয়তো কর্মকর্তারা নির্বাচনের আগে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে জনসমক্ষে আনতে চাচ্ছেন না।

জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে খারাপ খবর
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ অনুযায়ী নবজাতকের মৃত্যুহার বাড়ছে। মোট প্রজনন হারও স্থিতাবস্থায় আছে আট বছর ধরে। অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বাড়ছে না। এ বছরের মার্চ মাসে এই জরিপের তথ্য সংগ্রহ শেষ হলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, দাতা সংস্থা, দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষকদের কাছে স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র বিডিএইচএস। প্রতি তিন-চার বছর পর এ জরিপ হয়।

সর্বশেষ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে গত মার্চের মধ্যে। নিপোর্টের একটি সূত্র বলছে, গত ৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে জরিপের মুখ্য ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে ১২ ও ১৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে দুটি পরামর্শ সভা হয়।
ওই সব সভায় উপস্থাপিত জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, দেশে নবজাতক (০-২৮ দিন বয়সী) মৃত্যুহার ৩০। ১ হাজার সন্তান জন্ম নিলে ২৮ দিন বয়স হওয়ার আগেই ৩০টি শিশু মারা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ২৮। অর্থাৎ গত তিন বছরে নবজাতকের মৃত্যুর প্রবণতা বেড়েছে।

তবে এক বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার অপরিবর্তিত আছে। ২০১৪ সালে এই হার ছিল ৩৮, সর্বশেষ জরিপেও তা একই রয়েছে। যদিও ২০১৪ সালের আগের প্রতিটি জরিপে শিশুমৃত্যুর হার ক্রমাগত কমতে দেখা গিয়েছিল।

এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।

জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আহছানুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সময় দিলে আনুষ্ঠানিকভাবে জরিপ ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তবে নির্বাচনের কারণে আপাতত তা হচ্ছে না। ২০১৯ সালের আগস্টের আগে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।

প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে প্রস্তুত নয়
মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য সেবাসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রস্তুত থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপ প্রতিবেদনে। এই জরিপ প্রথম হয় ২০০৯ সালে। এরপর ২০১১ ও ২০১৪ সালে দুটি জরিপ হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হচ্ছে না।

২০১৭ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশের ১ হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রথম আলোর কাছে আসা জরিপের মুখ্য ফলাফলে দেখা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, প্রসব-পূর্ব সেবা ও প্রসবসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি জেলা হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির মান গত তিন বছরে কমেছে। এনজিওর প্রতিষ্ঠানে একমাত্র পরিবার পরিকল্পনা সেবা ছাড়া অন্যগুলোর মান কমেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি শূন্য। সব ধরনের সেবার ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রস্তুতির মান নিম্নপর্যায়ের এবং গত তিন বছরে তার উন্নতি হয়নি বলে খসড়া প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।

মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি। এসব প্রতিকারে হাসপাতালে অক্সিটসিন ও ম্যাগনেশিয়াম সালফেট রাখতে হয়। কিন্তু জরিপের সময় ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অক্সিটসিন ও ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট পাননি জরিপকারীরা।

জরিপকারীরা ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে থার্মোমিটার পাননি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মাত্র ২২ শতাংশ হাসপাতালে এক্স-রে যন্ত্র পেয়েছিলেন। ৪৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে শিশুর যত্নে কোনো প্রশিক্ষিত জনবল পাওয়া যায়নি। গর্ভধারণ, প্রস্রাবে শর্করা, প্রস্রাবে প্রোটিন, রক্তে শর্করা ও হিমোগ্লোবিন পরিমাপের পাঁচটি যন্ত্র একসঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে।

জানা গেছে, এ বছর আগস্টের ১২, ২৮ ও ৩০ তারিখে জরিপের মুখ্য ফলাফল নিয়ে তিনটি পরামর্শ সভা হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আহছানুল আলম বলেন, আগামী জুনের আগে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত হবে না।

তিনটি জরিপের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কী কারণে জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না, তা জানা যাচ্ছে না। সরকার ব্যাখ্যাও দিচ্ছে না। এতে পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হচ্ছে, বিষয় বিশ্লেষণের সংকট হবে। গবেষকেরা তাহলে কোন পরিসংখ্যান ব্যবহার করবেন? তিনি বলেন, যদি কোনো দুর্বলতা থাকে, কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে, তাহলে সরকার তার ব্যাখ্যা দিতে পারে। কিন্তু তথ্য চেপে রাখলে সংকট বাড়তেই থাকে।